সোনালি মিনিকেট চাল
সম্প্রতি সোনালি মিনিকেট
চাল" নামে একটি চালের নামকরণ করা হয়েছে যাকে অনেকে ডায়াবেটিস রাইস বলে দাবি
করছেন। এই চাল আবিষ্কার করেছেন জিন বিজ্ঞানী এবং ধান গবেষক ড. আবেদ চৌধুরী। তাঁর
মতে এই চালের ভাত খেলে রক্তে শর্করা এবং সুগার কমে যায়। ফলে ডায়াবেটিস অনেকটা
নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।আসুন এই সোনালি মিনিকেট চাল এবং এর সাথে জড়িত ডায়াবেটিস রাইস
সম্পর্কে কিছু তথ্য জানার চেষ্টা করি।
সোনালি মিনিকেট চাল
জিন বিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরি এই
চালটি উদ্ভাবন করেছেন মূলত অন্যান্য সাদা বা চিকন চালের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ার জন্য।
যা মেশাতে হবে মূল চালের সঙ্গে ১৫ শতাংশ করে। এতে ওই সাদা চালের সুগার বাড়ার
ক্ষমতা অনেক কমে যায়। কিন্তু সেই চালের সঙ্গে যে সোনালি মিনিকেট মেশানো হয়েছে তা
বোঝা যায় না।সোনালি মিনিকেট চাল, এটি পরে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি
অনুমোদন করে। তাঁর এইচকেজি এগ্রো থেকে প্রস্তুত বিশেষ এই চাল খেলে কার্বোহাইড্রেড
এবং সুগার কমে যায়। ফলে ডায়াবেটিস অনেক নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। সোনালী চালের বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান হাজীপুর কৃষিঘর-এর ব্যবস্থাপক সৈয়দ নূর
আহমদ দাউদ (সৌরভ) বলেন, সোনালী চাল উৎপাদন থেকে শুরু করে প্যাকেটজাত
করা পর্যন্ত কঠোরভাবে গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তাই এই চাল বাজারের অন্যান্য
চালের চেয়ে আলাদা এবং কার্যকরী।রেনেটা অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কর্তৃপক্ষ
জানিয়েছে, লো জিআই চালের দাম পড়বে প্রতি কেজি ১০০ টাকা।
বিভিন্ন সুপার স্টোর ও ওষুধের দোকানে এটি পাওয়া যাবে।
© এছাড়াও ভারতের ছত্তিশগড়ের ‘চাপাতি
গুরমাটিয়া’ শ্রেণির ধানের মধ্যে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের গুণাবলির সন্ধান পাওয়া গেছে।
ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস একটি ব্যাধি যা শরীরে
পর্যাপ্ত পরিমাণ ইনসুলিন না থাকা বা অগ্নাশয়ে প্রয়োজনীয় ইনসুলিন উৎপাদন না হওয়ার
জন্য সৃষ্ট শারীরিক সমস্যা। ইনসুলিন একটি হরমোন যা রক্তের মধ্যে বিদ্যমান গ্লুকোজ
শুষে নেয় এবং শরীরে শক্তি জোগায়। মানুষ যখন খাবার খায় তখন অগ্নাশয় প্রাপ্ত গ্লুকোজ
শুষে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ইনসুলিন উৎপাদন করে। তবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের
শরীরে প্রয়োজনীয় ইনসুলিন থাকে না অথবা উৎপাদিত হয় না। অথবা শরীরে যে ইনসুলিন
উৎপাদিত হয় তা শরীর গ্রহণ করে না। ফলে রক্তের মধ্যে গ্লুকোজ জমা হয় এবং প্রস্রাবের
সাথে শরীর থেকে বেড়িয়ে যায়। ফলে শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তির অভাব দেখা দেয়।
© বিশ্বে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর
সংখ্যা ৪০ কোটি। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি হিসাব অনুযায়ী, এ দেশে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে এখনই কার্যকর
উদ্যোগ না নিলে বিশ্বে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা আগামী ’৩০ সালের মধ্যে ৫৫ কোটি
ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স ও ডায়াবেটিস
খাবার
গ্লাইসেমিক একটি সংখ্যা সূচক যা
রক্তে গ্লোকোজের পরিমাণ নির্দেশ করে। আমরা যা খাই রক্তে ২-৩ ঘণ্টা পর যে গ্লুকোজের
পরিমাণ হয় তার পরিমাপকে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বলে। এটি পরিমাপ করার জন্য, যে কোনও খাদ্য কে গ্লুকোজের সাথে
তুলনা করা হয়, যা পয়েন্টে ১০০ হিসাবে গণনা করা হয়।
© ১৯৮০ সালে ইউনিভার্সিটি অব
টরোন্টোর গবেষক ডা. ডেভিড এ. জেনকিনস সর্বপ্রথম গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স এর গাণিতিক
হিসাব প্রবর্তন করেন। খাদ্যে গ্লুকোজের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে গ্লাইসেমিক সূচক
তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয় যেমন: উচ্চ গ্লাইসেমিক যুক্ত খাদ্য (জি আই ৭০-১০০) যে
খাদ্য রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দেয়। মধ্যম গ্লাইসেমিক যুক্ত খাদ্য (জি
আই ৫৬-৬৯)। নিম্ন গ্লাইসেমিক যুক্ত খাদ্য (জি আই ৫৫ বা তারও কম), যা ধীর গতিতে রক্তে গ্লুকোজ
সরবরাহ করে।
১) উচ্চ গ্লাইসেমিক যুক্ত খাদ্য (জি আই ৭০-১০০):
যে সমস্ত খাবার খেলে দ্রুত গ্লুকোজের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ
অস্বাভাবিক ওঠানামা করে, সেগুলো উচ্চ গ্লাইসেমিক যুক্ত খাবার। যেমন-
কর্নফ্লেক্স, মুড়ি, সাদা চাল, নুডলস, পনির, মিষ্টি কুমড়া, গোল আলু, পপকর্ন, আনারস, বাতাবিলেবু, ইত্যাদি।
২) মধ্যম গ্লাইসেমিক যুক্ত খাদ্য (জি আই ৫৬-৬৯):
যেসব খাবার রক্তে গ্লুকোজের
পরিমাণ পরিমিত করে, তাহলো মাঝারি সূচক যুক্ত খাদ্য। যেমন-তরল পানীয়, মিষ্টি ভুট্টা, কিসমিস, পাকা কলা, মধু, বাসমতি চাল ইত্যাদি।
৩) নিম্ন গ্লাইসেমিক যুক্ত খাদ্য (জি আই ০০- ৫৫ )
খাবার রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ
বাড়ায় হজম প্রক্রিয়াকে ধীর করে এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্থিতিশীল রাখে, তাহলো নিম্ন সূচক যুক্ত খাদ্য।
যেমন- গম, যব, লাল চাল, মেটে আলু, মিষ্টি আলু, ভুট্টা, শিম, চীনাবাদাম, গাজর, ডাল, প্রায় সব ধরনের ফল, শাক সবজি। ফলের মধ্যে বিশেষ ভাবে
উল্লেখযোগ্য আপেল, কমলা লেবু, টমেটো, খেজুর, আঙ্গুর, ইত্যাদি।
তাই নিম্ন গ্লাইসেমিক সূচক যুক্ত খাবার খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।
নিম্ন সূচকযুক্ত খাবার দীর্ঘ সময় শক্তি দেয়। এই ধরনের নিয়মিত খাবারের সাথে
ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং অন্যান্য রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কম
হবে। আপনার যদি ইতিমধ্যে ডায়াবেটিস থাকে তাহলে এই খাবার রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ
নিয়ন্ত্রণ করবে। ইনসুলিনের পরিমাণ বাড়াবে।
গ্লাইসেমিক সূচক পরিবর্তন হয়:
আঁশ যুক্ত খাদ্য গ্লাইসেমিক সূচক
কমাতে সহায়তা করে। সাধারণভাবে বেশী রান্না করা বা প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে গ্লাইসেমিক
সূচক বেড়ে যায়। একই ভাবে বেশী পাকা ফল বা সবজিতেও উচ্চ মাত্রায় গ্লাইসেমিক সূচক
থাকে। আলু ভর্তায় আস্ত পোড়া আলুর চেয়ে উচ্চহারে গ্লাইসেমিক সূচক থাকে। সাদা চালে
লাল চালের চেয়ে বেশী গ্লাইসেমিক সূচক থাকে।
ডায়াবেটিস রাইস:
যেহেতু সাদা চালের গ্লাইসেমিক
ইন্ডেক্স ৭০ বা তার চেয়ে বেশি, তাই বিজ্ঞানীরা মধ্যম ও কম
গ্লাইসেমিক সূচক যুক্ত জাত বা প্রযুক্তি বা পদ্ধতি বের করার চেষ্টা অব্যাহত
রেখেছেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি ধানের জাত ব্রি ধান-২৮ ও ব্রি ধান-২৯
যাদের গ্লাইসেমিক সূচক প্রায় ৫৬%।
© ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব
অ্যাগ্রিকালচার রিসার্চের বিজ্ঞানীরা এবার এই সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এসেছেন। কারণ
ডায়াবেটিসের সমস্যা এখন প্রায় সব ঘরেই। তাই নতুন কয়েকটি ধান তারা আবিষ্কার করেছেন, যা গ্লাইসেমিক ইনডেক্সে তুলনায়
অনেকটা নীচের দিকে থাকবে। এই ধানের জাতগুলোর নামগুলো যথাক্রমে ললাট ৫৩.১৭, বিপিটি ৫২০৪, সম্পদ ৫১ এবং সাম্বা মাশুরি ৫৩।
আসুন ডায়াবেটিকস রাইস নিয়ে কিছু পরিসংখ্যান জানার চেষ্টা করি:
১) একটি গবেষণায় দেখা গেছে, লম্বা আকৃতির চাল সিদ্ধ করলে তার
গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স মান ৮৩ থেকে কমে ৬৭ এ নেমে আসে। তাই, সিদ্ধ চালই ভালো।
২) সাদা চাল, বাসমতি চাল, বাদামি চাল, সিদ্ধ চালের জিআই মান যথাক্রমে ৭৩,৬৩,৬৮ ও ৩৮.
অর্থাৎ সিদ্ধ চাল অন্য চালের
তুলনায় অধিক নিরাপদ।
৩) এছাড়াও বিআর-৩,বিআর-১১, বিআর ১৬, বিআর-২৬, ব্রি ধান-২৮, ব্রি ধান-২৯, ব্রি ধান-৩৩, ব্রি ধান-৪০, ব্রি ধান ৪৭,ব্রি ধান ৪৯, ব্রি ধান ৫০, ব্রি ধান ৫৩, ব্রি ধান ৬২,পাইজাম, নাজিরশাইল, চিনিগুড়া এর গ্লাইসেমিক ইডেক্স
যথাক্রমে ৬৪.৪, ৬৮.২, ৪৬.৯,৭২.১,৫৯.৬,৭৭.৬, ৬৬.০, ৭২.১, ৬৭.০,৭১.৫, ৬৯.৩, ৭৭.৩, ৬৩.১, ৫৪.২, ৪২.০ ও ৭১.৭.
(সূত্রঃ বিভিন্ন
গবেষণা পেপার থেকে সংগৃহীত)
৪) যে সমস্ত জাতের ধানে কম
গ্লাইসেমিক ইনডেক্স, সেই সমস্ত জাতের ধানের চাল অধিক নিরাপদ।
৫) বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে, ভাতের সাথে ডাল, সবজি মিশালে গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স
ড্রামাটিক্যালি হ্রাস পায়।
৬) যে সমস্ত চালে এমাইলোজ বেশি
থাকে, সে সমস্ত চালে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম থাকে, ভাত ঝরঝরে হয়।
এখন তাহলে আমাদের কি করা উচিত?
১) সিংগেল পালিসড এক সিদ্ধ বা হাফ
সিদ্ধ চাল খাওয়া,
২) ভাতের দ্বিগুণ ডাল বা সবজি
জাতীয় খাবার খাওয়া
৩) একটি প্লেটের ০৪ ভাগের ০১ ভাগ
ভাত, বাকি ০৩ ভাগ সবজি, ডাল ইত্যাদি দিয়ে সাজান।
তাই, ব্লাক রাইস, ব্রাউন রাইস, সোনালি রাইস এর পিছনে ঘুরে ঘুরে
টাকা না ফুরিয়ে ভাতের সাথে সবজি, ডাল খাওয়ার অভ্যাস করি, টেনশন মুক্ত জীবন গড়ি।