পেঁয়াজ চাষ
সুখসাগর জাতের পেঁয়াজ চাষ পদ্ধতি
জাতের বৈশিষ্ট্যঃ-
এটি উচ্চ ফলনশীল উফশী জাতের পেঁয়াজ।পেঁয়াজের আকার চ্যাপ্টা, গোলাকার, বোঁটা চিকন,লালচে বর্ণের এবং অধিক ঝাঁঝযুক্ত। প্রতিটি পরিপক্ক পেঁয়াজ এর গড় ওজন ১৩০-১৫০ গ্রাম।
জীবনকালঃ-
১৩৫-১৪০ দিন।
বপন সময়ঃ-
২৫ শে আশ্বিন হতে ২০ শে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত।
মাটির ধরনঃ-
যে মাটিতে পানি জমে না এমন জমির মাটি অর্থাৎ দোঁআশ,বেলে দোঁআশ,এঁটেল দোঁআশ,পলি যুক্ত মাটি এই পেঁয়াজ চাষর জন্য উপযুক্ত মাটি।
জমি তৈরিঃ-
সুখসাগর জাতের পেঁয়াজ চাষ এর জন্য জমি প্রথমে ২ বার চাষ দেওয়ার পর ৩-৪ দিন মাটি শুকিয়ে গেলে ১ বিঘা (৩৩শতকে) ২০০০ (দুই হাজার) কেজি গোবর জাতীয় জৈব সার প্রয়োগ করে তারপর আবার ২ বার জমি চাষ দিতে হবে।এরপর ২-৩ দিন পর মাটি শুকিয়ে গেলে ট্রাক্টর অথবা পাওয়ার টিলার দ্বারা জমির উপরের মাটি ঝুরঝুরে করে চাষ দিয়ে মই দিয়ে মাটি সমান করতে হবে।মাটি ঝুরঝুরে করে চাষ দেওয়াকেই পেঁয়াজ চাষ এর ক্ষেত্রে শেষ চাষ বলা হয়।
মনে রাখতে হবে যে,শেষ চাষ দেওয়ার আগে জমিতে বিঘা প্রতি (৩৩ শতকে)---
টি এসপি ৪০ কেজি,
এম ও পি ২০ কেজি,
জিপসাম ৪০ কেজি,
বোরন ২ কেজি,
ইকোফুরান অথবা কার্বোফুরান জাতীয় দানাদার কীটনাশক ২ কেজি সবগুলো রাসায়নিক সারের সাথে একত্রে মিশিয়ে জমিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।সার প্রয়োগ ও শেষ চাষ দেওয়ার ১ দিন পর জমিতে সেচ প্রয়োগ এর সুবিদার্থে কয়েকটি কেয়ারি তৈরি করার পর প্লাবন পদ্ধতিতে সমস্ত জমিতে সেচ প্রয়োগ করতে হবে।সেচ দেওয়ার ৫-৬ দিন পর অর্থাৎ মাটিতে জোঁ আসলে ছোট হাত লাঙ্গল/বিন্দা/বিদা দ্বারা জমিতে লম্বা এবং আড়াআড়ি ভাবে টেনে মাটির উপরের অংশ আলগা/ঝুরঝুরে করে দিতে হবে।
বীজতলা ও চারা রোপনঃ-
বাংলাদেশের কৃষকরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি ব্যাবহার করে বীজতলা ও চারা রোপণ করে থাকে।ঠিক ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতেও এই জাতের বীজতলা তৈরি করে চারা রোপণ করে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
বীজ বপন ও ১ম সেচঃ-
বীজের পরিমানঃ-
১ বিঘা(৩৩ শতকে) জমিতে ১ কেজি ৮০০ গ্রাম বীজ বপন করতে হবে।
বীজ বপনের আগের দিন--
বীজ অবশ্যই ১-১.৫ ঘন্টা সময় রোদ্রে শুকানোর পর খোলা জায়গায় ছায়াযুক্ত স্থানে ১.৫-২ ঘন্টা শুকাতে হবে।
বিঃদ্রঃ বীজ রোদ্রে শুকানোর পর ছায়াযুক্ত স্হানে শুকানোর জন্য ফ্যানের পাখার দ্বারা অতিরিক্ত বাতাসে বীজ শুকানো যাবেনা।
বীজ বপনের দিন--
বীজ বপনের আগে ১.৫-২ ঘন্টা সময় বীজ পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে।এরপর ভিজানো বীজ জীবাণু মুক্ত করনের জন্য অন্য একটি পাত্রে কার্বোন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক ১ লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম মিশিয়ে আরো ১৫ মিনিট বীজ ভিজিয়ে রাখতে হবে। এরপর বীজ ঝুরঝুরে না হওয়া পর্যন্ত রোদ্রে শুকাতে হবে।এরপর সম্পুর্ন জমিতে বীজ ছিটিয়ে বপন করে প্লাবন সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
বিঃদ্রঃ সেচ প্রয়োগ এর সময় পানির স্রোতযুক্ত জায়গার বীজ অন্যত্র জায়গায় চলে যায় এ জন্য সেচ প্রয়োগ শেষ হওয়ার পর কিছু পরিমান বীজ স্রোতযুক্ত জায়গায় ছিটিয়ে দিতে হবে।
২য় সেচঃ-
১ম সেচ দেওয়ার ৬-৭ দিন পর অর্থাৎ মাটিতে জোঁ আসলে ২য় সেচ প্রয়োগ করতে হবে।এই সময় সেচ দেওয়ার আগে জমিতে কাটুই জাতীয় পোকা দমনের জন্য লেমডা সাইহ্যালোথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক ১০০ মিলি ৩ কেজি ইউরিয়া সারের সাথে মিশিয়ে ১ বিঘা (৩৩ শতক) জমিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করার পর ২য় সেচ দিতে হবে।
৩য় সেচঃ-
২য় সেচ দেওয়ার ৫-৬ দিন পর ৩য় সেচ দিতে হবে।৩য় সেচ দেওয়ার আগে জমিতে ৪ কেজি ইউরিয়া সারের সাথে সামান্য পানির সাথে ১ কেজি থিয়োভিট মিশিয়ে ১ বিঘা(৩৩ শতক) জমিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
৪র্থ সেচঃ-
৩য় সেচের ৮-৯ দিন পর অর্থাৎ মাটিতে জোঁ আসলে ৪র্থ সেচ দিতে হবে।৪র্থ সেচ দেওয়ার সময় জমিতে আগাছা থাকলে সেচ দেওয়ার আগের দিন বিকেলে পেঁয়াজের জমির জন্য নির্ধারিত ফেনোক্সাপ্রোপ ও অক্সাডায়াজন ২৫ ইসি গ্রুপের আগাছানাশক বোতলের গায়ে অনুমোদিত নির্দেশনা মোতাবেক পরিমিত মাত্রায় সমস্ত জমিতে স্প্রে করতে হবে।৪র্থ সেচ দেওয়ার ১-২ ঘন্টা আগে জমিতে থ্রিপস,জাবপোকা দমনের জন্য ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক এবং রোগ দমনের জন্য মেনকোজেব+কার্বেন্ডাজিম অথবা মেনকোজেব+ মেটালোক্সিল গ্রুপের ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় পানির সাথে একত্রে মিশিয়ে সমস্ত জমিতে স্প্রে করতে হবে।এবং ৪র্থ সেচের আগে পরবর্তী সময়ে জমিতে ঘাস না জন্মানোর জন্য ৬ কেজি ইউরিয়া সারের সাথে পেন্ডিমেথালিন গ্রুপের আগাছানাশক ২০০ মিলি একত্রে মিশিয়ে ১ বিঘা(৩৩ শতক) জমিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
৫ম সেচঃ-
৪র্থ সেচের ৯-১০ দিন পর অর্থাৎ মাটিতে জোঁ আসলে ৫ম সেচ দিতে হবে।৫ম সেচ দেওয়ার আগে জমিতে নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।এর পর পোকা দমনের জন্য ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক এবং রোগ দমনের জন্য টেবুকোনাজল, মেনকোজেব+কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক,চিলেটেড জিংক অনুমোদিত মাত্রায় জমিতে স্প্রে করতে হবে।৫ম সেচের আগে ১ বিঘা (৩৩ শতক) জমিতে--
ইউরিয়া ১০ কেজি,
এম ও পি ৭ কেজি,
টি এস পি ১৫ কেজি,
এবং পরবর্তীতে জমিতে ঘাস না জন্মানোর জন্য পেন্ডিমেথালিন গ্রুপের আগাছানাশক অনুমোদিত মাত্রায় ২ কেজি ইউরিয়া সারের সাথে মিশানোর পর সবগুলো সারের সাথে একত্রে মিশিয়ে জমিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
৬ষ্ঠ সেচঃ-
৫ম সেচের ১১-১২ দিন পর অর্থাৎ মাটিতে জোঁ আসলে ৬ষ্ঠ সেচ দিতে হবে।৬ষ্ঠ সেচের আগে নিড়ানি দিয়ে জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।এই সময় নিড়ানি দেওয়ার সাথে সাথে পেঁয়াজ এর চারার ঘন জায়গায় চারা পাতলাকরন করতে হবে।এরপর জমি থেকে ঘন চারা তুলে একই জমির শুন্য/ফাঁকা স্থান পুরনের জন্য চারা লাগিয়ে দিতে হবে। জমিতে চারা পাতলা করনের পর অবশিষ্ট চারা অন্য জমিতেও সেচ প্রদানের সাথে সাথে লাগানো যাবে।৬ষ্ঠ সেচের আগে পোকা দমনের জন্য ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক এবং রোগ দমনের জন্য টেবুকোনাজল, ইপ্রোডিয়ন গ্রুপের ছত্রাকনাশক,চিলেটেড জিংক অনুমোদিত মাত্রায় জমিতে স্প্রে করতে হবে।৬ষ্ঠ সেচের আগে ১ বিঘা জমিতে (৩৩ শতক) জমিতে
ইউরিয়া ২০কেজি
ডি এ পি ২৫ কেজি
এম ও পি ১০ কেজি
ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ৫ কেজি
দস্তা ৩ কেজি
শুধুমাত্র দস্তা ও ডিএপি সার একসাথে মিশ্রিত না করে আলাদা ভাবে আগে পরে জমিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।এছাড়া সকল সার একত্রে মিশিয়ে জমিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
৭ম সেচঃ-
৬ষ্ঠ সেচের ১২-১৩ দিন পর অর্থাৎ মাটিতে জোঁ আসলে ৭ম সেচ দিতে হবে।৭ম সেচের আগে জমিতে আগাছা থাকলে নিড়ানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। এই সময় পেঁয়াজের পার্পল ব্লচ রোগের আক্রমন হতে পারে এ জন্য ৭ম সেচের আগে পোকা দমনের জন্য ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক এবং পার্পল ব্লচ রোগ দমনের জন্য ফ্লুওপিরাম+ট্রাইফ্লোক্সিস্ট্রবিন, টেবুকোজনাল+ট্রাইফ্লোক্সিস্ট্রবিন, ইপ্রোডিয়ন গ্রুপের ছত্রাকনাশক,পি জি আর (প্লান্ট গ্রোথ রেগুলেটর) গাছ দ্রুত বর্ধনশীল হরমোন জাতীয় ঔষধ অনুমোদিত মাত্রায় একত্রে মিশিয়ে জমিতে স্প্রে করতে হবে।৭ম সেচের আগে ১ বিঘা জমিতে (৩৩ শতক) জমিতে---
ইউরিয়া ২০ কেজি
টিএসপি ২৫ কেজি
এম ও পি ১০ কেজি
সবগুলো সার একত্রে মিশিয়ে জমিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
৮ম সেচঃ- ৭ম সেচের ১৩-১৪ দিন পর অর্থাৎ মাটিতে জোঁ আসলে ৮ম সেচ দিতে হবে।৮ম সেচ দেওয়ার আগে জমিতে আগাছা থাকলে নিড়ানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।এই সময় পেঁয়াজ গাছের নিচে ছোট গুটি তৈরি হওয়া আরম্ভ হয়। ৮ম সেচের আগে পোকা দমনের জন্য ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক এবং রোগ দমনের জন্য ফ্লুওপিরাম+ট্রাইফ্লোক্সিস্ট্রবিন অথবা টেবুকোজনাল+ট্রাইফ্লোক্সিস্ট্রবিন, কার্বেন্ডাজিম অথবা ইপ্রোডিয়ন গ্রুপের ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় একত্রে মিশিয়ে জমিতে স্প্রে করতে হবে।৮ম সেচের আগে ১ বিঘা জমিতে (৩৩ শতক) জমিতে--
ইউরিয়া ২০ কেজি
টি এস পি ২৫ কেজি
এই দুই প্রকার সার একত্রে মিশিয়ে জমিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
৯ম সেচঃ-
৮ম সেচের সময় জমির পেঁয়াজ গাছের নিচে পেঁয়াজ এর গুটি হওয়া আরম্ভ হলে ৮ম সেচের ২৪-২৫ দিন পর ৯ম জমিতে সেচ দিতে হবে।৯ম সেচ দেওয়ার আগে পেঁয়াজ আরো বেশি মোটা পরিপক্ক করনের জন্য ১ বিঘা(৩৩ শতক)জমিতে--
সালফেট ১০ কেজি
সার জমিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
পেঁয়াজ পরিপক্ক ও কর্তনঃ-
৯ম সেচের ১৪ -১৫ দিন পর গাছ হেলে মাটিতে পড়ে গেলে পেঁয়াজ পরিপক্ব হয়ে পেঁয়াজ কর্তন/তোলার উপযুক্ত হয়।
পেঁয়াজের ফলনঃ-
১ বিঘা (৩৩ শতক) জমিতে ১৮০-২০০ মন পর্যন্ত পেঁয়াজ উৎপাদন হয়।
পেঁয়াজ সংরক্ষণঃ-
পেঁয়াজ কর্তন/তোলার পর পরিপক্ক পেঁয়াজ এর শুকনো বোটা আঁটি করে বেঁধে বাঁশের খুঁটিতে টাঙিয়ে এবং মাচা পদ্ধতি ব্যবহার করে ঘরের ভিতর ৯-১০ মাস সংরক্ষণ করা যায়।এবং সংরক্ষিত পেঁয়াজ এর বাল্ব/কন্দ মাটিতে রোপন করে দানা বীজ উৎপাদন করা যায়।
মোঃ ইখলাছ উদ্দীন
উপ-সহকারী কৃষি অফিসার
মুজিব নগর,মেহেরপুর।
ব্লকঃ- আনন্দবাস।
মোবাইলঃ- ০১৭২৩০৯৬৪৬৮.