কমলা চাষ পদ্ধতি

 

কমলালেবুর সঠিক চাষ পদ্ধতি 

কমলা চাষ পদ্ধতি।


চারা উৎপাদন: যৌন ও অযৌন উভয় পদ্ধতিতেই কমলার বংশ বিস্তার করা যায়। কমলার বীজ থেকে চারা উৎপাদনকরা যেতে পারে। কমলার বীজ থেকে একাধিক চারা পাওয়া যায়, যার মধ্যে একটি যৌন ও বাকিগুলো অযৌন।তুলনামূলকভাবে সতেজ ও মোটা চারাসমূহ অযৌন চারা বা নিউসেলার চারা হিসেবে পরিচিত। গুটি কলম, চোখ কলম ও জোড় কলম এর মাধ্যমে অযৌন চারা উৎপাদন করা যায়। কমলা উৎপাদনের জন্য রোগ প্রতিরোধী আদিজোড়ের উপর কলমকৃত অযৌন চারা উত্তম।

জমি তৈরি: জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। সমতল ভূমিতে আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে এবং পাহাড়ি অঞ্চলে কোদালের সাহায্যে জমি তৈরি করতে হবে। জমি তৈরির পর উভয় দিকে ৪-৫ মিটার দূরত্বে ৬০ দ্ধ ৬০ দ্ধ ৬০ সেমি আকারে গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্তের মাটি তুলে পাশে রেখে দিতে হবে। বর্ষার পূর্বে গর্ত মাটি দিয়ে ভর্তি করে রাখতে হবে। কমলা চাষের নির্বাচিত জমি পাহাড়ি হলে সেখানে ৩০-৫০ মিটার দূরত্বে ২-৪টি বড় গাছ রাখা যেতে পারে। তবে বড় গাছ কাটলে শিকড়সহ তুলে ফেলতে হবে। তারপর পাহাড়ের ঢাল অনুসারে নকশা তৈরিকরে নিতে হবে।


মাদা তৈরি: চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পূর্বে উভয় দিকে ৪-৫ মিটার দূরত্বে ৭৫ সেমি দ্ধ ৭৫ সেমি দ্ধ ৭৫ সেমি মাপের গর্ত করতে হবে। প্রতি গর্তে ১৫ কেজি পচা গোবর, ৩-৫ কেজি ছাই, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি এবং২৫০ গ্রাম চুন গর্তের উপরের মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। গর্ত ভরাট করার ১০-১৫ দিনপর চারা রোপণ করতে হবে। চারা রোপণ পদ্ধতি ও সময়: সমতল ভূমিতে বর্গাকার কিংবা ষড়ভুজাকার এবং পাহাড়ী জমিতে কন্টুর পদ্ধতিতে কলমরোপণ করতে হবে। চারা কলম রোপণের পর হালকা ও অস্থায়ী ছায়ার ব্যবস্থা করতে পারলে ভাল। বর্ষার শুরুতে অর্থাৎবৈশাখ (মে-জুন) মাস কমলার চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। তবে সেচের ব্যবস্থা থাকলে যে কোন মৌসুমে কমলার চারা লাগানো যায়।

চারা রোপণ ও পরিচর্যা: সুস্থ সতেজ ১.০-১.৫ বছর বয়সের চারা/কলম সংগ্রহ করে গর্তের মাঝখানে এমনভাবে রোপণকরতে হবে যেন চারার গোড়ার মাটির বলটি ভেঙ্গে না যায়। চারা রোপণের পর গাছের গোঁড়ার মাটি ভালভাবে চেপে দিয়েহালকা সেচ দিতে হবে। রোপণের পর চারা যাতে হেলে না পড়ে সে জন্য শক্ত খুটি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে।

গাছে সার প্রয়োগ: গাছের যথাযথ বৃদ্ধির জন্য সময়মতো, সঠিক পরিমাণে এবং সঠিক পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। 


উপরোল্লিখিত সারের অর্ধেক ফল সংগ্রহের পর অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসে এবং বাকি অর্ধেক ফল মার্বেল আকার ধারণ করারপর অর্থাৎ এপ্রিল মাসে প্রয়োগ করতে হবে। ফলবান গাছের ডালপালা যে পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে তার নিচের জমি কোদাল দিয়ে হালকা করে কুপিয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে। 


পানি সেচ ও নিষ্কাশন: বয়স্ক গাছে খরা মৌসুমে ২-৩টি সেচ দিলে কমলার ফলন ও গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। ফলেরবাড়ন্ত অবস্থায় সেচ দিলে ফলের আকার বড় ও রসযুক্ত হয়। গাছের গোড়ায় পানি জমলে মাটি বাহিত রোগের প্রকোপবৃদ্ধি পায়। তাই অতিরিক্ত পানি নালার মাধ্যমে নিষ্কাশন করে দিতে হবে।


ডালপালা ছাঁটাইকরণ: কমলা গাছের জন্য ডাল ছাঁটাই অপরিহার্য। গাছ লাগানোর পর ফল ধরার পূর্ব পর্যন্ত ধীরে ধীরে ডাল ছেঁটে গাছকে নির্দিষ্ট আকার দিতে হবে যাতে গাছ চারিদিকে ছড়াতে পারে। কারণ পার্শ্ব ডালগুলিতে ফল বেশি ধরে। কাণ্ডের এক মিটার উচ্চতা পর্যন্ত সব ডাল ছাঁটাই করতে হবে। ডাল ছাঁটাই করার পর ডালের কাটা অংশে বর্দোপেস্টের প্রলেপ দিতে হবে।

আগাছা দমন: আগাছা কমলা গাছের বেশ ক্ষতি করে। গাছের গোড়ায় যাতে আগাছা জন্মাতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। গাছের উপরে পরগাছা ও লতাজাতীয় আগাছা থাকলে তা দূর করতে হবে।

ফল সংগ্রহ ও সংগ্রহোত্তর পরিচর্যা: ফল ভালভাবে পাকার পর অর্থাৎ কমলা বর্ণ ধারণ করলে সংগ্রহ করতে হবে। এতেফলের মিষ্টতা বৃদ্ধি পায়। গাছ হতে ফল সংগ্রহ করার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে ফলগুলোতে যাতে আঘাত না লাগে। তাজা ফল হিমাগারে সংরক্ষণ করলে ১০০ সে. তাপামাত্রায় ও ৮০-৯০% আপেক্ষিক আর্দ্রতায় ২ মাস পর্যন্ত এবং ৫.৬০সে. তাপমাত্রায় ৩ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। তাজা ফল সংগ্রহের পর ১৩ শতাংশ তরল মোমের আবরণ দিয়েসাধারণ তাপমাত্রায়ও ২৫ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা সম্ভব।


অন্যান্ন পরিচর্য

 লিফ মাইনার পোকা

এটি লেবু জাতীয় ফসলের অন্যতম মারাত্মক শত্রæ। সাধারণত গ্রীষ্ম ও শরৎকালে গাছে নতুন পাতা গজালে এ পোকার আμমণ লক্ষ্য করা যায়। এ পোকার কীড়াগুলো পাতার উপত্বকের ঠিক নিচের সবুজ অংশ খেয়ে আকা-বাঁকা সুড়ঙ্গের মত সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে পাতার কিনারার দিক মুড়ে পুত্তলীতে পরিণত হয়। আμমণের মাত্রা তীব্র হলে গাছের পাতা কুঁকড়ে যায় ও বিবর্ণ হয়ে শুকিয়ে ঝরে পড়ে। আক্রন্ত পাতায় ক্যাঙ্কার রোগ হয়। গাছ দুর্বল হয়ে যায় ও গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।

প্রতিকার

* পরিচ্ছনড়ব চাষাবাদ করতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় লার্ভাসহ আμান্ত পাতা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

*প্রতি লিটার পানিতে ০.২৫ মিলি এডমায়ার ২০০ এমএল বা ২ মিলি কিনালাক্স ২৫ ইসি মিশিয়ে ১০-১৫দিন পর পর ৩-৪ বার কচি পাতায় ¯েপ্র করতে হবে।


ফলের মাছি পোকা

পূর্ণাঙ্গ পোকা আধা পাকা ফলের ভিতরে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে লার্ভা বা কীড়া বের হয়েফলের শাঁস খেতে থাকে। পরবর্তী সময়ে আক্রন্ত স্থানে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া জন্মে।আক্রন্ত ফল পচে যায় এবং খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে।

প্রতিকার

আক্রন্ত ফল সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে বা মাটির গভীরে পুঁতে ফেলতে হবে। ফল পরিপক্ক হওয়ার সাথে সাথে ফল সংগ্রহ করতে হবে। সেক্স ফেরোমন ফাঁদ দ্বারা পূর্ণাঙ্গ পুরুষ পোকা মারা যেতে পারে। আগস্ট মাস থেকে ফল সংগ্রহের পূর্ব পর্যন্ত বাগানে ১০ মিটার অন্তর এ ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে।


ড্যাম্পিং অফ

লেবুজাতীয় ফলের নার্সারির জন্য এটি একটি মারাত্মক রোগ। বীজ গজানোর পূর্বে বাপরে উভয় সময়েই এ রোগের আμমণ হতে পারে। এ রোগের আক্রমণে চারাগোড়ার দিকে পচে যায় এবং চারা মরে যায়। বর্ষা মৌসুমে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশিহয়।


প্রতিকার

বীজতলায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত সেচ দেয়া যাবে না এবং দ্রæত পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। বীজতলায় ঘন করে চারা লাগানো যাবে না।

গ্রিনিং

কমলা ও মাল্টা জাতীয় গাছের গ্রিনিং একটি মারাত্মক ব্যাক্টেরিয়াজনিত রোগ। সাধারণত রোগাঅক্রন্ত গাছের পাতা দস্তার অভাবজনিত লক্ষণের ন্যায় হলদে ভাব ধারণ করে। পাতার শিরা দুর্বল হওয়া, পাতা কিছুটা কোঁকড়ানো ও পাতারসংখ্যা কমে আসা, গাছ ওপর থেকে নিচের দিকে মরতে থাকা ও ফলের সংখ্যা কমে যাওয়া হলো এ রোগের প্রধানলক্ষণ। এ রোগ সাইলিডবাগ নামক এক প্রকার পোকা দ্বারা  আক্রন্ত হয়। রোগাক্রন্ত গাছ থেকে ডাল নিয়ে জোড়কলম, শাখা কলম বা গুটি কলম করলে নতুন গাছেও এ রোগ দেখা দেয়।


প্রতিকার

মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রতি মাসে একবার সুমিথিয়ন ৫০ ইসি প্রয়োগ করে এ রোগ বিস্তারকারী সাইলিডবাগ দমন করতে হবে। আক্রন্ত গাছ উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। বাগানের সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গাছকে সুস্থ ও সবলরাখতে হবে।

গামোসিস ফাইটোফথোরা নামক ছত্রাকের আμমণে এ রোগ হয়। রোগাঅক্রন্ত গাছের কাণ্ড ও ডাল বাদামী বর্ণ ধারণ করে। আμান্ত ডালে লম্বালম্বি ফাটল দেখা দেয় এবং ফাটল থেকে আঠা বের হতে থাকে। আμান্ত ডালের পাতা হলুদ হয়ে যায় এবং ডাল উপর দিক থেকে মরতে থাকে। কাÐ বা ডালের সম্পূর্ণ বাকল রিং আকারে নষ্ট হয়ে গাছ মারা যায়। মাটিতে অতিরিক্ত পানি জমে গেলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। গাছের শিকড় ও গোড়ার বাকল ফেটে ক্ষতের সৃষ্টি হলে ক্ষতস্থানের ভিতর দিয়ে এ রোগের জীবাণু প্রবেশ করে।

প্রতিকার

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পনড়ব আদিজোড়/রুট স্টক যেমন- রংপুর লাইম, রাফ লেমন, ক্লিওপেট্রা ম্যান্ডারিন, কাটা জামির প্রভৃতি ব্যবহার করতে হবে। পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা করা এবং গাছকে সবল ও সতেজ রাখা। মাটি স্যাঁত স্যাঁতে হতে না দেয়া এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি সেচ না দেয়া। আক্রন্ত স্থান ছুঁরি দ্বারা চেছে বর্দোপেস্ট এর প্রলেপ দেয়া (১০০ গ্রাম তুঁতে ও ১০০ গ্রাম চুন আলাদা পাত্রে গুলিয়ে পরিমিত পানিতে মিশিয়ে বর্দোপেস্ট তৈরি করতে হবে)।

ক্যাঙ্কার

এটি একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। কমলা ও অন্যান্য লেবু জাতীয় ফলের কচি বাড়ন্ত কুঁড়ি, পাতা ও ফলে এ রোগের আক্রমণ বেশি হয়। আক্রন্ত পাতার উভয় পাশে খসখসে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ক্ষত অংশের চতুর্দিকে গোলাকার হলুদ কিনারা দেখা যায়। পাতা হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে এবং আক্র্রন্ত ডগা উপর দিক থেকে মরতে থাকে। ফলের উপর আক্রমণ বেশি হলে ফল ফেটে যায় ও ঝরে পড়ে। ঘন ঘন বৃষ্টি হলে এ রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত বাতাস জনিত কারণে ও লিফ মাইনার পোকার আμমণে গাছের ফল ও পাতায় যে ক্ষতের সৃষ্টি হয় তার ভিতর দিয়ে জীবাণু প্রবেশ করে এ রোগের সৃষ্টি করে।

প্রতিকার

বৃষ্টির মৌসুম আরম্ভ হওয়ার পূর্বেই বর্দোমিক্সার বা কুপ্রাভিট ৫০ ডাব্লিউ পি অথবা কপার অক্সিক্লোরাইড প্রয়োগ করতে হবে এবং সমগ্র বর্ষা মৌসুমে প্রতি মাসে একবার উল্লিখিত ছত্রাকনাশক গুলোর যে কোন একটি স্প্রে করতে হবে।আক্রন্ত ফল ও পাতা কেটে ফেলতে হবে এবং বাগানে জমে থাকা আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। লিফ মাইনার নামক পোকা দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে। যে অঞ্চলে বাতাস বেশি হয় সেখানকার বাগানের চারদিকে বাতাস প্রতিরোধক গাছ লাগাতে হবে।

ডাইব্যাক বা আগা মরা রোগ কমলা গাছের জন্য এটি অত্যন্ত জটিল এবং মারাত্মক রোগ। বিভিনড়ব প্রকার ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে। সাধারণত রোগাμান্ত দুর্বল গাছ এবং মাটিতে রস ও খাদ্যোপাদানের স¦ল্পতার জন্য এ রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। আμান্ত গাছের পাতা ঝরে যায় ও আগা থেকে ডালপালা শুকিয়ে নিচের দিকে আসতে থাকে এবং আস্তে আস্তে পুরো গাছটিই মরে যায়।


প্রতিকার

পরিচর্যার মাধ্যমে গাছকে সবল ও সতেজ রাখা যায়। মরা ডাল ২.৫ সেমি সবুজ অংশসহ কেটেফেলা এবং কর্তিত অংশে বর্দোপেস্ট লাগাতে হবে। বছরে ২/১ বার গাছে কুপ্রাভিট ৫০ ডবিøউপি অথবা কপার অক্সিক্লোরাইড প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ¯েপ্র করা প্রয়োজন। ফলের খোসা মোটা ও রস কম জাতগত বৈশিষ্ট্যের কারণে, দস্তা বা ফসফরাসের ঘাটতি হলে এবং পরিপক্ক হওয়ার পূর্বেই ফল সংগ্রহ করা হলে এ সমস্যা হয়।

প্রতিকার

সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম জিঙ্ক অক্সাইড অথবা ৫ গ্রাম জিঙ্ক সালফেট মিশিয়ে ১০-১৫দিন পর পর ৩-৪ বার পাতায় ও ফলে ¯েপ্র করতে হবে। অনুমোদিত জাতের চাষ করতে হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url