ট্রাইকোডার্মা

ট্রাইকোডার্মা |

ট্রাইকোডার্মা কোথায়,কিভাবে ব্যবহার করবেন।

ট্রাইকোডার্মা হল হিপোক্রিসি পরিবাররে একটি প্রজাতির  ছত্রাক যা মাটিতে বসবাস করে। ১৭৯৪ সালে ক্রিস্টিয়ান হেনড্রিক পার্সুন  ট্রাইকোডার্মা  শ্রেণী ও এটা  নিয়ে প্রথম আলোচনা করন।

গাছের ছত্রাকজনিত রোগের বিরুদ্ধে বায়োকন্ট্রল হিসাবে উদ্ভাবিত হয়েছে। এটি কৃষি এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে  ব্যবহার হয়ে থাকে নিম্নে কৃষি ক্ষেত্রে ট্রাইকোডার্মা এর ভুমিকা আলোচনা করা হলো। ট্রাইকোডার্মা উপযুক্ত জৈব (ছত্রাক ও নেমাটোড) নিয়ন্ত্রক। রোগ সৃষ্টিকারী ছত্রাকের গোত্র ফিউজিরিয়াম, পিথিয়াম রাইজোকটনিয়া, ফাইটোপথোরা প্রভৃত দমন করে। মাটিবাহিত রোগ দমনে অধিক ব্যবহার হয়।


ট্রাইকোডার্মা একটি উপকারী ছত্রাক। যা উদ্ভিদকে ব্যাকটেরিয়া থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করে।
ট্রাইকোডার্মা মাটিতে জন্মানো রোগ থেকে ফসল, শাকসবজি রক্ষা করার জন্য খুব কার্যকরী জৈবিক অনুজীব।
এটি একটি মুক্ত জীবিত ছত্রাক যা মাটি ও মুলের ইকোসিস্টেম গুলিতে জন্মায়। এটি মুল, মাটি এবং পাথরের পরিবেশে অত্যান্ত কার্যকর। এটি এন্টিবায়োসিস, মাইকোপারসিটিজম হাইফাল ইন্টারঅ্যাকশন এবং এনজাইম নিঃসরণের মতো বিভিন্ন প্রক্রিয়া দ্বারা সৃষ্ট রোগজীবাণু বৃদ্ধি বা সংক্রমণ হ্রাস করে,
তারা এমন একটি বাধা তৈরি করে যা ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া এবং প্যাথোজেনগুলির কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত করে।
ট্রাইকোডার্মা প্রকৃতি থেকে আহরিত এমনই একটি অনুজীব যা জৈবিক প্রদ্ধতিতে উদ্ভিদের রোগ দমনের জন্য ব্যবহার করা যায়। ফলে জমিতে রাসায়নিক সারের ব্যাবহার কমবে ৪০-৬০ শতাংশ। এটি ট্রাইকো সাসপেনশন পাউডার এবং পেষ্ট আকারে উৎপাদন সম্ভব। নিয়মানুযায়ী স্প্রে করলে এর অতি উত্তম কার্যকারিতা পাওয়া যায়।
প্রকৃতি ও মাটিতে বসবাসকারী হওয়ায় একবার ব্যাবহারের ফলে দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত স্থায়ীভাবে থেকে যায়, পচা আবর্জনায় ট্রাইকো- সাসপেনশন এর জলীয় দ্রবণ মিশিয়ে দ্রুত সময়ে ট্রাইকো কম্পোস্ট উৎপাদন করা সম্ভব।

ট্রাইকোডার্মা ছত্রাকটি চারটি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। এগুলো হলোঃ
১.ট্রাইকোডার্মা হারজিআম
২. ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি
৩. ট্রাইকোডার্মা লঙ্গিব্রাচিয়াটাম
৪. ট্রাইকোডার্মা রিসেই


এগুলোর প্রত্যেকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও গুনাবলী রয়েছে।

বিশ্বের প্রতিটি মহাদেশের স্থানীয় মাটিতে জৈবিক ভাবে ট্রাইকোডার্মা পাওয়া যায়। এগুলো বিভিন্ন তাপমাত্রার মাটিতে পাওয়া যায়। তবে ৭৭-১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মধ্যে সবচেয়ে ভালো মানের ট্রাইকোডার্মা ছত্রাক পাওয়া সম্ভব। এই তাপমাত্রার বাইরে ছত্রাকটি ততোটা কার্যকরী হয়না।
ট্রাইকোডার্মা অত্যন্ত স্থিতিস্থাপক, এটির অভিযোজন ক্ষমতা অতুলনীয়। যেকোনো ভারী ধাতু এবং ব্যাকটেরিয়ায় এরা দিব্যি বেচে থাকতে পারে। মাটি খনন, অবকাঠামো নির্মান,কীটনাশকের অধিক ব্যাবহার,খরা,বন্যা এবং প্রচন্ড উত্তাপের ফলে উপকারী ব্যাকটেরিয়া ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে।
প্রাকৃতিকভাবেই এটি মাটি থেকে সৃষ্ট রোগ থেকে এটি ফসলকে নির্মূল করছে।৷
তাই এটিকে ল্যাবরেটরিতে এনে জার্মিনেশন ঘটিয়ে বায়োকম্পোস্ট এবং বায়োফার্টিলাইজার তৈরি করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে ট্রাইকোডার্মার পেক্ষাপটঃ-
# ট্রাইকোডার্মা বায়োপেস্টিসাইড বাংলাদেশের উপযোগী করে সর্বপ্রথম আবিস্কার করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ডঃ মোঃ বাহাদুর মিয়া, বগুড়ার আর ডি এ ল্যাবের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রের উপযোগী করে বাজারে নিয়ে আসা হয় ২০১৩ সালের জুন মাসে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ৭ টির মতো পুনাঙ্গ ল্যাবে ট্রাইকোডার্মা উৎপাদন করে বানিজ্যিক ভাবে বায়োপেস্টিসাইড ও কম্পোস্ট। এটি ব্যাবহারে ৪০- ৬০ ভাগ রাসায়নিক সারের ব্যাবহার কমায়। ট্রাইকোডার্মা সাসপেনশন থেকে তৈরি বায়োপেস্টিসাইড ব্যাবহারে কীটনাশকের খরচ কমায় ৩০ ভাগ পর্যন্ত।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যান তত্ত্ববিভাগের অধ্যাপক আ ফ ম জামালউদ্দিনের গবেষণায় দেখা গেছে ট্রাইকোডার্মা প্রয়োগকৃত টমেটোর ১.৫ গুন ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ ট্রাইকোডার্মা একই সাথে ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে কৃষকের খরচ কমাচ্ছে। এজন্য ট্রাইকোডার্মা কম্পোস্ট ও বায়োপেস্টিসাইড শহরের ছাদ বাগানে টেকসই অর্গানিক ফার্মিংকে আরো বাস্তবায়ন ঘটাতে একটি উপলক্ষ হতে পারে।

ট্রাইকোডার্মার উপকারিতাঃ-

১. রোগ নিয়ন্ত্রণে -
ট্রাইকোডার্মা একটি শক্তিশালী বায়োকন্ট্রোল এজেন্ট এবং মাটিতে জন্মানো রোগের জন্য ব্যাপকহারে ব্যাবহৃত হয়। এটি বিভিন্ন প্যাথোজনিক ছত্রাক যেমন- ফিউজেরিয়াম, ফাইটোপথেরা, সে্ক্লেরেশিয়া এর বিরুদ্ধে সফলভাবে ব্যাবহৃত হয়েছে।

২. উদ্ভিদ বৃদ্ধিতে সহায়ক-
ট্রাইকোডার্মা ফসফেট এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টকে পানিতে দ্রবীভুত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ট্রাইকোডার্মা উদ্ভিদে প্রয়োগের ফলে এর গভীরে শিকড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটায় ফলে খরা প্রতিরোধী করতে উদ্ভিদের ক্ষমতাকে আরো বাড়িয়ে তোলে।

৩. রোগের জৈব রাসায়নিক এজেন্ট -
ট্রাইকোডার্মা ফসলের প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রভাবিত করতে সহায়তা করে। ট্রাইকোডার্মা দ্বারা উৎপাদিত তিনটি শ্রেণির উদ্ভিদের প্রতিরোধী ক্ষমতা প্ররোচিত করার সক্ষমতা এখন বহুল আবিষ্কৃত। এই যৌগগুলি প্রয়োগকৃত গাছের ইথিলিন, উচ্চসংবেদনশীল প্রতিক্রিয়ায় সাড়া প্রদান ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত প্রতিক্রিয়া প্ররোচিত করে।

৪.ট্রান্সজেনিক গাছপালা-
ট্রাইকোডার্মার এন্ডোকাইটিনেজ জিংক তামাক এবং আলু গাছের ছত্রাকের বৃদ্ধির প্রতিরোধী ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলেছে। অলটারনারিয়া, অল্টানাটা সোলানী এবং বোট্টিটিস সিরেরিয়া বিভিন্ন মাটিবাহিত রোগজীবাণু রিজেক্টেনিয়া এস পি পি তে যেমন পাতাগুলি প্যাথোজেনগুলির পক্ষে সহনশীল।

৫. জৈব প্রতিষোধক-
কীটনাশক ও ভেষজনাশক দ্বারা দুষিত মাটির জৈব শোধনে ট্রাইকোডার্মা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে এবং অপ্রয়োজনীয় কীটনাশকের ব্যাবহার হ্রাস করে।

৬. মাটির বিষক্রিয়া হ্রাস-
ট্রাইকোডার্মা মাটিতে কেমিক্যাল ও কীটনাশকের আধিক্যজনিত বিষক্রিয়া সৃষ্টি হলে তা কমাতে সাহায্য করে এবং একইসাথে মাটির অম্লতা ও পি এইচ এর মাত্রা সঠিক রাখতে সহায়তা করে।

৭. মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা -
মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষায় সাহায্য করে এবং উর্বর শক্তিকে দীর্ঘস্হায়ী করে ফলে মাটি পুষ্টি সমৃদ্ধ হয় ও মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।


ট্রাইকোডার্মার উপকারিতাঃ

# মাটি ও বীজবাহিত রোগের ক্ষতিকর জীবানু ধ্বংস করে মাটি ও বীজকে শোধন করে।
# মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সু- রক্ষায় সহায়তা করে ও উর্বরতা শক্তিকে দীর্ঘস্থায়ী করে ফলে মাটি পুষ্টি সমৃদ্ধ হয় ও উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ে।
# জমিতে কেমিক্যাল সার ও কীটনাশকের আধিক্যজনিত কোন বিষক্রিয়া সৃষ্টি হলে তা কমাতে সাহায্য করে ও একই সাথে মাটির অম্লতা ও পি এইচ এর মাত্রা সঠিক রাখতে সহায়তা করে।
# মাটিতে অবস্থিত অজৈব পদার্থকে উদ্ভিদের খাদ্যে পরিনত করতে সহায়তা করে ও মাইক্রো অর্গানিজম এর অধিক বৃদ্ধি করে গন্ধক দস্তা প্রভৃতির ঘাটতি দুর করতে সহায়তা করে।
ফলে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
# মাটিতে পানির ধারন ক্ষমতা বাড়িয়ে ফসল সতেজ রাখে।
# সঠিক মাত্রায় ব্যাবহারে ফসলে ৩০- ৪০ ভাগ পর্যন্ত রাসায়নিক সারের ব্যাবহার সাশ্রয় করে।


প্রয়োগ মাত্র ও প্রয়োগক্ষেত্র : ধান, গম, আলু, আম, ইক্ষু, বেগুন, পিঁয়াজ, কুমড়া, শাশা, পটল, করল, চিচিংগা, ঝিংগা, ঢেঁড়স,বাঁধাকপি, ফুলকপি, মরিচ, পান, আনারস, কলা, তরমুজ, তুলা, চা এবং ফুল জাতীয়া ফসল।


বীজ শোধন : প্রতি কেজি বীজের জন্য ৩০ গ্রাম   ট্রাইকোডার্মা পাউডার বীজের সাথে মিশিয়ে ছায়াযুক্ত স্থানে শুকিয়ে বপন করতে হবে।

চারা শোধন : প্রতি লিটার পানিতে ১০ গ্রাম   ট্রাইকোডার্মা পাউডার পানিতে মিশিয়ে চারার গোড়া ৩০ মিনিট চুবিয়ে রেখে চারা রোপন করতে হবে।


রোগ দমন :   ট্রাইকোডার্মা পউডার পঁচন, ঢলে পড়া, বীজ শোধন, ডাউনি-পাউডার, মিলডিউ ও সিগাটোগা ব্যবস্থপনায় ব্যবস্থাপনায় কার্যকর।


উদ্ভিদির বৃদ্ধি বর্ধন : * ফসফেট, আয়রন ও অন্যান্য  অনুখাদ্য (মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট) উদ্ভিদের গ্রহণযোগ্য অবস্থায় নিয়ে আসে।


* হরমোন, অক্সিন ও ইনডোল-৩-এসিটিক এসিড  তৈরি করে যা শিকড় বৃদ্ধি ঘটিয়ে পুষ্টি ও পানি গ্রহণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, ফলশ্রতিতে খরা সহনশীলতা ও ফলন বৃদ্ধি পায়।

* বীজের অংকুরোদগমের হার বৃদ্ধি করে।

* পাতার বৃদ্ধির মাধ্যমে উদ্ভিদে সালোক-সংশ্লেষণের হার বৃদ্ধি করে।


জৈব প্রতিবিধায়ক : * অর্গানোক্লোরিন, অর্গানোফসফেট ও কার্বোনেট জাতীয় বালাইনশকের অবশিষ্টাংশ ভেঙ্গে ফেলে। * মাটির গঠন ও পানি ধারন ক্ষমতার উন্নতি সাধন করে।


মাটি শোধন : একর প্রতি ২ কেজি   ট্রাইকোডার্মা পাউডার ২০০-৩০০ কেজি জৈব সারের (লক্ষ রাখতে হবে জৈব সার ভেজা ভেজা থাকে) সাথে মিশিয়ে রেখে ৭-১০ দিন পর জমিতে শেষ চাষে প্রয়োগ করুন।

আক্রন্ত গাছ : প্রতি লিটার পানিতে ৩-৫ গ্রাম পাউডার মিশিয়ে গাছের গোড়াসহ ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।


সতর্কতা :  ট্রাইকোডার্মা ব্যবহারের ৩-৭ দিন পূর্বে এবং পরে কোন ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করা যাবে না। শুষ্ক শীতল ছায়াযুক্ত স্থানে সংরক্ষণ করুন।


আরো পড়ুন ট্রাইকোডার্মা ছত্রাকের বৈশিষ্ট্য|


ধন্যবাদ সকলকে

আমিন

কৃষি পরামর্শ Group


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url