ফসলের পরিচর্যা

 মাঘ মাসের কৃষি।


মাঘ মাসের কনকনে শীতের হাওয়ার সাথে কিছু উষ্ণতার পরশ নিয়ে আবার আপনাদের মাঝে হাজির হচ্ছি আগামী মাসের কৃষি নিয়ে। মাঘের শীতে বাঘ পালালেও মাঠ ছেড়ে আমাদের পালানোর কোনো সুযোগ নেই। কেননা এ সময়টা কৃষির এক ব্যস্ততম সময়। আসুন আমরা সংক্ষেপে জেনে নেই মাঘ মাসে কৃষিতে আমাদের করণীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো-

 

ফসল / অবস্থা/বিবরণ /করণীয়  

 

বোরো ধান

পরিচর্যা    

মাঠে বোরো ধানের বাড়ন্ত পর্যায় এখন। এ সময় বোরো ধানে প্রয়োজন সারের উপরি প্রয়োগ, নিয়মিত সেচ প্রদান, আগাছা দমন, বালাই ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য পরিচর্যা করতে হবে। ইউরিয়া সারের উপরি প্রয়োগের উপযুক্ত সময় এখন। ধানের চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর প্রথম কিস্তি, ৩০-৪০ দিন পর দ্বিতীয় কিস্তি এবং ৫০-৫৫ দিন পর শেষ কিস্তি হিসেবে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া চারা রোপণের ৭-১০ দিনের মধ্যে গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করতে পারেন। এতে একরে ৬৫ কেজি গুটি ইউরিয়ার প্রয়োজন হয়।

 

বালাই ব্যবস্থাপনা

এ সময় ধান ক্ষেতে রোগ ও পোকার আক্রমণ দেখা দিতে পারে। রোগ ও পোকা থেকে ধান গাছকে বাঁচাতে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ, আন্তঃপরিচর্যা, যান্ত্রিক দমন, উপকারী পোকা সংরক্ষণ, ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ধানক্ষেত বালাই মুক্ত করতে পারেন। এসব পন্থায় রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিহত করা না গেলে শেষ উপায় হিসেবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সঠিক বালাইনাশক, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।

 

গম

আন্তঃপরিচর্যা ও সেচ প্রদান

গমের জমিতে যেখানে ঘন চারা রয়েছে তা পাতলা করে দিতে হবে। এ সময় গমের শিষ বেড় হয়।  যদি শিষ বেড় হয় বা গম গাছের বয়স ৫৫-৬০ দিন হয় তবে জরুরিভাবে গম ক্ষেতে একটি সেচ দিতে হবে। এতে গমের ফলন বৃদ্ধি পাবে। মনে রাখতে হবে ভালো ফলনের জন্য দানা গঠনের সময় আরেকবার সেচ দেয়া বেশি জরুরি। এ সময় গম ক্ষেতে ইঁদুরের উপদ্রব হয়ে থাকে তাই ইঁদুর দমন জরুরি। তবে ইঁদুর দমনের কাজটি করতে হবে সম্মিলিতভাবে।

 

ভুট্টা    

আন্তঃপরিচর্যা ও সেচ প্রদান    

ভুট্টা ক্ষেতের গাছের গোড়ার মাটি তুলে দিতে হবে এবং গোড়ার মাটির সাথে ইউরিয়া সার ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর সেচ প্রদান করতে হবে এবং গাছের নিচের দিকের মরা পাতা ভেঙে দিতে হবে। ভুট্টার সাথে সাথী বা মিশ্র ফসলের চাষ করে থাকলে সেগুলোর প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে।

 

আলু    

বালাই ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যা    

আলু ফসলে নাবি ধসা রোগ দেখা দিতে পারে। সে কারণে স্প্রেয়িং শিডিউল মেনে চলতে হবে। তবে বালাইনাশক প্রয়োগের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করা দরকার। এছাড়া বালাইনাশক কেনার আগে  তা ভালোমানের কিনা তা যাচাই করে নিতে হবে। মড়ক রোগ দমনে দেরি না করে ২ গ্রাম ডায়থেন এম ৪৫ অথবা সিকিউর অথবা ইন্ডোফিল প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। মড়ক লাগা জমিতে সেচ দেয়া বন্ধ করতে হবে। তাছাড়া আলু ফসলে মালচিং, সেচ প্রয়োগ, আগাছা দমনের কাজগুলোও করতে হবে।  আলু  গাছের বয়স ৯০ দিন হলে মাটির  সমান করে গাছ কেটে দিতে হবে এবং ১০ দিন পর আলু তুলে ফেলতে হবে। আলু তোলার পর  ভালো করে শুকিয়ে বাছাই করতে হবে এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

তুলা    

সংগ্রহ    

এ সময় তুলা সংগ্রহের কাজ শুরু করতে হবে। তুলা সাধারণত ৩ পর্যায়ে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। শুরুতে ৫০% বোল ফাটলে প্রথম বার, বাকি ফলের ৩০% পরিপক্ব হলে দ্বিতীয় বার এবং অবশিষ্ট ফসল পরিপক্ব হলে শেষ অংশের তুলা সংগ্রহ করতে হবে। রৌদ্রময় শুকনা দিনে বীজ তুলা উঠাতে হয়। ভালো তুলা আলাদাভাবে তুলে ৩-৪ বার রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, ভালো তুলার সাথে যেন খারাপ তুলা (পোকায় খাওয়া, রোগাক্রান্ত) কখনও না মেশে।

 

ডাল ও তেল ফসল    

সংগ্রহ    

মসুর, ছোলা, মটর, মাসকালাই, মুগ, তিসি পাকার সময় এখন। সরিষা, তিসি বেশি পাকলে রোদের তাপে ফেটে গিয়ে বীজ পড়ে যেতে পারে, তাই এগুলো ৮০ ভাগ পাকলেই সংগ্রহের ব্যবস্থা নিতে হবে। আর ডাল ফসলের ক্ষেত্রে গাছ গোড়াসহ না উঠিয়ে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি রেখে ফসল সংগ্রহ করতে হবে। এত জমিতে উর্বরতা এবং নাইট্রোজেন সরবরাহ বাড়বে।

 

শাকসবজি    

পরিচর্যা    

শীতকাল শাকসবজির মৌসুম। নিয়মিত পরিচর্যা করলে শাকসবজির ফলন অনেক বেশি পাওয়া যায়। এছাড়া ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, ওলকপি, শালগম, গাজর, শিম, লাউ, কুমড়া , মটরশুঁটি এসবের নিয়মিত যত্ন নিতে হবে। টমেটো ফসলের মারাত্মক পোকা হলো ফলছিদ্রকারী পোকা। ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে পুরুষ মথকে ধরে সহজে এ পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রতি বিঘা জমির জন্য ১৫টি ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। তাছাড়া ক্ষেতে পতঙ্গভুক পাখি বসার  ব্যবস্থা করতে হবে। আধাভাঙ্গা নিম বীজের নির্যাস (৫০ গ্রাম এক লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ১২ ঘণ্টা ভেজাতে হবে এবং পরবর্তীতে মিশ্রনটি ভালো করে ছাকতে হবে) ১০ দিন পর পর ২/৩ বার স্প্রে করে এই পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আক্রমণ তীব্র হলে কুইনালফস গ্রুপের কীটনাশক (দেবীকইন ২৫ ইসি/কিনালাক্স ২৫ ইসি/করোলাক্স ২৫ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার পরিমাণ মিশিয়ে স্প্রে করে এ পোকা দমন করা যায়। এ সময় চাষিভাইরা টমেটো সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করতে পারেন। আধা পাকা টমেটোসহ টমেটো গাছ তুলে ঘরের ঠাণ্ডা জায়গায় উপুড় করে ঝুলিয়ে টমেটোগুলোকে পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। পরবর্তীতে ৪-৫ মাস পর্যন্ত অনায়াসে টমেটো খেতে পারবেন। আর শীতকালে মাটিতে রস কমে যায় বলে সবজি ক্ষেতে চাহিদামাফিক সেচ দিতে হবে। তাছাড়া আগাছা পরিষ্কার, গোড়ায় মাটি তুলে দেয়া, সারের উপরিপ্রয়োগ ও রোগবালাই প্রতিরোধ করা জরুরি।

 

গাছপালা    

পরিচর্যা    

শীতে গাছের গোড়ায় নিয়মিত সেচ দিতে হবে, গোড়ার মাটি আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছামুক্ত রাখতে হবে। সাধারণত এ সময় আম গাছে মুকুল আসে। গাছে মুকুল আসার পরপরই এ মুকুল বিভিন্ন প্রকার রোগ এবং পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো আমের অ্যানথ্রাকনোজ রোগ।  এ রোগ দমনে গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার পূর্ব পর্যন্ত আক্রান্ত গাছে টিল্ট-২৫০ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি অথবা ২ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া আমের আকার মটর দানার মতো হলে গাছে ২য় বার স্প্রে করতে হবে। এ সময় প্রতিটি মুকুলে অসংখ্য হপার নিম্ফ দেখা যায়। আম গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার পূর্বেই একবার এবং এর একমাস পর আর একবার প্রতি লিটার পানির সাথে ১.০ মিলি সিমবুস/ফেনম/ডেসিস ২.৫ ইসি মিশিয়ে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপাল ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।

 

প্রাণিসম্পদ    

হাঁস-মুরগির যত্ন  

শীতকালে পোলট্রি তে যেসব সমস্যা দেখা যায় তা হলো-অপুষ্টি, রানীক্ষেত, মাইকোপাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমা। মোরগ-মুরগির অপুষ্টিজনিত সমস্যা সমাধানে ভিটামিন এ, সি, ডি, ই, কে ও ফলিক এসিড সরবরাহ করতে হবে। তবে সেটি অবশ্যই প্রাণিচিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করতে হবে।  

 

শীতের তীব্রতা বেশি হলে পোলট্রি শেডে অবশ্যই মোটা চটের পর্দা লাগাতে হবে এবং বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পোলট্রি লিটারে অ্যামোনিয়া গ্যাস রোধে ১ বর্গফুট জায়গায় ১ কেজি হারে অ্যামোনিল পাউডার মিশাতে হবে। শীতকালে মোরগ-মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সপ্তাহে দুই দিন খাবারের সাথে ভিটামিন ই এবং ভিটামিন সি মিশিয়ে দিতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলে অনেকেই হাঁস পালন করে থাকেন। এ সময় হাঁসের নানা রোগও হয়ে থাকে।  হাঁসের যেসব রোগ হয় সেগুলো হলো- হাঁসের প্লেগ রোগ, কলেরা রোগ এবং বটুলিজম। প্লেগ রোগ প্রতিরোধে ১৮-২১ দিন বয়সে প্রথম মাত্রা এবং প্রথম টিকা দেয়ার পর ৩৬-৪৩ দিন বয়সে দ্বিতীয় মাত্রা পরবর্তী ৪-৫ মাস পরপর একবার ডাক প্লেগ টিকা দিতে হবে।  হাঁসের কলেরা রোগের জন্য ডাক কলেরা টিকা ৪৫-৬০ দিন বয়সে ১ বার, ৬০-৭৫ দিন পর দ্বিতীয় বার এবং পরবর্তী ৪-৫ মাস পর পর টিকা দিতে হবে।

 

গরু-বাছুরের যত্ন  

গোখামারে শীতকালে মোটা চটের ব্যবস্থা করা খুব জরুরি।  নাহলে গাভীগুলো তাড়াতাড়ি অসুস্থ হয়ে যাবে। এ সময় গাভীর খাবার প্রদানে যেসব বিষয়ে নজর দিতে হবে তাহলো- সঠিক সময়ে খাদ্য প্রদান, গোসল করানো, থাকার স্থান পরিষ্কার করা, খাদ্য সরবরাহের আগে খাদ্য পাত্র পরিষ্কার করা এবং নিয়মিত প্রাণিচিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া। তবে গাভীর খাবারের খরচ কমাতে সবচে ভালো হয় নিজেদের জমিতে তা চাষাবাদ করা। আর একটি কাজ করলে ভালো হয় সেটি হলো-সমবায় সমিতি করে ওষুধ ও চিকিৎসা করানো। এতে লাভ হয় বেশি। খরচ যায় কমে।  

 

মৎস্যসম্পদ    

মাছের যত্ন  

শীতকালে মাছের বিশেষ যত্ন নেয়া দরকার। কারণ এ সময়ে পুকুরে পানি কমে যায়। পানি দূষিত হয়। মাছের রোগবালাইও বেড়ে যায়। সে কারণে কার্প ও শিং জাতীয় মাছে ড্রপসি বা উদর ফোলা রোগ বেশি হয়। এ রোগ প্রতিরোধে মাছের ক্ষত রোগ যাতে না হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। আর এ রোগের প্রতিকারে প্রতি কেজি খাদ্যের সাথে ১০০ মিলিগ্রাম টেরামাইসিন বা স্ট্রেপটোমাইসিন পর পর ৭ দিন খাওয়াতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় এ বিষয়ে আপনার কাছের উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ গ্রহণ করা।

 

সুপ্রিয় পাঠক, অত্যন্ত সংক্ষেপে মাঘ মাসে কৃষিতে করণীয় কাজগুলোর উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরা হলো। আপনারা আপনাদের অভিজ্ঞতা ও পরিবেশের গ্রহণযোগ্যতার সমন্বয়ে কৃষিকে নিয়ে যেতে পারেন এক আলোকিত ভুবনে। কৃষির যে কোন সমস্যায় উপজেলা কৃষি অফিস, উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস ও উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে পারেন। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আর আপনাদের মেধা, ঘাম, সচেতনতা এবং আন্তরিকতাই এ দেশের কৃষিকে নিয়ে যাবে সাফল্যের শীর্ষে। সোনালি মাঠ, প্রান্তর, দিগন্ত কৃষির উজ্জ্বল আভায় উদ্ভাসিত হবে। কথা হবে আগামী সংখ্যায়। সবার জন্য শুভ কামনা।

 

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন

সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url