জৈব বালাইনাশক দিয়ে পোঁকামাকড় দমন করার কৌশল।

পোঁকামাকড় দমন করার কৌশল।

জৈব বালাইনাশক দিয়ে পোঁকামাকড় দমন করার কৌশল

Strategies to control insects with organic pesticides.

মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করার ফলে আজ নিরাপদ খাদ্যের উৎপাদন ও যোগান দেয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে । তবে ধীরে ধীরে আধুনিকতার পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি ধাবিত হচ্ছে জৈব কৃষিতে। চলুন জেনে নেই জৈব ও যান্ত্রিক পদ্ধতিতে মরিচের পোকামাকড় দমন করার উপায়-

সাদা মাছি (White Fly)
️ক্ষতির ধরণঃ
√ সাদা রংয়ের এ পোকা পাতার নিচের অংশে থেকে পাতার রস চুষে খায়।
√ ফলে পাতা কুঁচকে যায়। আক্রমণে প্রথমে পাতায় সাদা বা হলদেটে রং দেখা যায় পরে দাগগুলো একত্রে হয়ে সবুজ শিরাসহ পাতা হলুদ হয়ে যায় অর্থাৎ ভাইরাস রোগ ছড়ায়।
√ এ পোকা খাওয়ার সময় আঠালো মিষ্টি রস নি:সরণ করে বিধায় ঐ আঠাতে কালো ছত্রাক জন্মাতে সহায়তা করে।


⏩জৈবিক ও যান্ত্রিক পদ্ধতিতে দমন ব্যবস্থাপনাঃ
>প্রতি ১ লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে কাপড় কাঁচা সাবান মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

>হলুদ রংয়ের আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে।
>জৈব বালাইনাশক হিসেবে প্রতি ১ লিটার পানিতে ১ মিলি হারে “ইকোম্যাক” ও ১ মিলি হারে “কেমাইট” মিশিয়ে ১ সপ্তাহ অন্তর গাছের পাতার নিচের অংশ ভালোভাবে ভিজিয়ে পর্যায়ক্রমে স্প্রে করতে হবে।

মাকড় (Mite)
️ক্ষতির প্রকৃতিঃ
√ লার্ভা এবং পূর্ণ বয়স্ক মাইট গাছের কোষ ছিদ্র করে রস শোষণ করে এবং বিষাক্ত পদার্থ নিঃসৃত করে।
√ গাছে খাদ্য তৈরি এবং পানি স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হয়। পাতা সরু, ফ্যাকাশে, মোচড়ানো এবং নিচের দিকে বাঁকানো হয়।
√ পাতা চামড়ার মতো হয়ে যায় এবং শিরাগুলো মোটা হয়।
√ পাতা এবং কচি কাণ্ড লালচে বর্ণের হয়।
√ ফুলের কুঁড়ি বাঁকানো এবং মোচড়ানো হয়। গাছের বৃদ্ধি বিঘ্নিত হয়, কচি গাছের আকার ছোট হয় এবং বয়স্ক গাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে ফুল ঝরে পড়ে।
√ ফল বিকৃত, ক্ষতবিশিষ্ট, অপরিপক্ব এবং অসম আকৃতির হয়। ফলের উৎপাদন এবং বাজার মূল্য কমে যায়। সাধারণত নতুন পাতা এবং ছোট ফলে মাইট বেশি দেখা যায় কারণ এ পোকা শক্ত টিস্যু খেতে পারে না।
√ লার্ভা এবং পূর্ণ বয়স্ক মাইটগুলো পাতার নিচের দিক খেতে বেশি পছন্দ করে।
√এ পোকা মরিচ ছাড়াও তুলা, বেগুন, পেয়ারা, লেবু জাতীয় ফসল, পাট, পেঁপে, আলু, টমেটো, আম, বরবটি, তিল, আঙ্গুরসহ বিভিন্ন ফসল এবং বিভিন্ন শোভা বর্ধনকারী গাছেও আক্রমণ করে থাকে।


⏩জৈবিক ও যান্ত্রিক পদ্ধতিতে দমন ব্যবস্থাপনাঃ
√আক্রমণের শুরুতে হাত দিয়ে আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে ধ্বংশ করতে হবে।
√নিরাপদ জৈব বালাইনাশক ইকোম্যাক প্রতি ১ লিটার পানিতে ১ মিলি হারে ও কেমাইট ১ মিলি হারে অথবা, বায়োনিম ০.৩% ইসি মিশিয়ে ১ সপ্তাহ অন্তর গাছের পাতার নিচের অংশ ভালোভাবে ভিজিয়ে পর্যায়ক্রমে স্প্রে করতে হবে।

সতর্কতাঃ
মরিচ উৎপাদনের জন্য ছায়ামুক্ত স্থান নির্বাচন করতে হবে। ফল সংগ্রহের সময় অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে যাতে সংগ্রহকারীর কাপড় এবং শরীর দ্বারা মাইটগুলো আক্রান্ত গাছ থেকে অনাক্রান্ত গাছ বা ক্ষেতের মধ্যে ছড়াতে না পারে। বিভিন্ন অপোষক ফসলের সঙ্গে আন্তঃফসল করতে হবে এবং এর শস্য পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সেচ প্রয়োগের মাধ্যমে এর আক্রমণ কমানো সম্ভব।

জাব পোকা (Aphid )
️ক্ষতির ধরণঃ
√ অতি ছোট, নরম ও উজ্জ্বল কাল রংয়ের এ পোকার পূর্ণাঙ্গ পোকা ও নিম্ফ (বাচ্চা) পাতা, ফুল, কচি ফল ও ডগার রস চুষে খায়।
√ ফলে পাতা কুঁকড়ে যায়, গাছের বৃদ্ধি ও ফুল, ফল ধারণ বাধাগ্রস্থ হয়।
√ বাতাসে আদ্রতা বেশী ও মেঘলা কালে এ পোকা বেশি বিস্তার লাভ করে।
জৈবিক ও যান্ত্রিক পদ্ধতিতে দমন ব্যবস্থাপনাঃ
√ আক্রমণের শুরুতে ব্রাশ দিয়ে পোকা পরিষ্কার করে কিংবা হাত দিয়ে সংগ্রহ করে ধ্বংশ করতে হবে।
√ আঠালো হলুদ ফাঁদ প্রতি হেক্টরে ৪০ টি ব্যাবহার করা যায় । আধা ভাঙ্গা নিম বীজের (৫০ গ্রাম এক লিটার পানিতে ২৪ ঘণ্টা ভেজানর পর মিশ্রণটি ছাঁকতে হবে) রস আক্রান্ত গাছে ১০ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে ।

️হলুদ ফাঁদঃ
হলুদ ফাঁদ মূলত বিভিন্ন পোকার (বিশেষতঃ জাব পোকার) উপস্থিতি ও পরিমাণ বুঝার জন্য ব্যবহার করা হয় । ফসলের ক্ষেতে গ্লু/আঠা মিশ্রিত হলুদ কাপড় টাঙিয়ে দেয়া হয়। জাব পোকা সেখানে উড়ে এসে পড়ে এবং গ্লুতে/আঠাতে আটকে যায়। পরে পানিতে কাপড়টি ধুয়ে নিলে সব পোকা মারা যায়। কাপড়টিতে পুনরায় আঠা লাগিয়ে ব্যবহার করা যাবে।

√ জমিতে বন্ধু পোকা লেডি বার্ড বিটলের পূর্নাঙ্গ পোকা ও কীড়া সংরক্ষণ করতে হবে ।
√ জৈব বালাইনাশক হিসেবে প্রতি ১ লিটার পানিতে ১ মিলি হারে “ইকোম্যাক” ও ১ মিলি হারে “কেমাইট” মিশিয়ে ১ সপ্তাহ অন্তর গাছের পাতার নিচের অংশ ভালোভাবে ভিজিয়ে পর্যায়ক্রমে স্প্রে করতে হবে।
অথবা বায়োট্রিন প্রতি লিটার পানিতে ১.৫ মিলি হারে মিশিয়ে শেষ বিকেলে স্প্রে করতে হবে।
অথবা নিমবিসাইডিন প্রতি লিটার পানিতে ৫ মিলি হারে মিশিয়ে শেষ বিকেলে স্প্রে দিতে হবে।


থ্রিপস (Thrips)

️ক্ষতির ধরণঃ
পোকার বাচ্চা ও বয়স্ক পোকা উভয়ই কচি পাতার নিচের পৃষ্ঠে বসে খায়।
√ এরা পাতার কোষ কলা ছিদ্র করে এবং পাতার রস শুষে নেয়।
√ আক্রান্ত পাতা হালকা বাদামি থেকে রুপালি বর্ণ ধারণ করে এবং কুঁকড়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
√ আক্রান্ত গাছের পাতা নৌকার মতো উপরের দিকে গুটিয়ে যায়।
√ আক্রান্ত ফুলের বোঁটা বাদামি রঙের হয়ে ঝড়ে পরে।
√ পরে ফলেও হালকা বাদামী ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায়।
√ এ পোকা ভাইরাস রোগও ছড়ায়।

অনুকূল পরিবেশঃ
যদিও পোকার উপদ্রব সারা বছর দেখা যায়, তবে শুকনো মৌসুমে এবং মাটিতে মাত্রাতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করলে এর প্রাদুর্ভাব বেশি হয়।
পেঁয়াজ, রসুন এ জাতীয় বা ধানের বীজতলা কাছে থাকলে সতর্ক থাকুন।


⏩জৈবিক ও যান্ত্রিক পদ্ধতিতে দমনঃ
*প্রাথমিক অবস্থায় শুকনো ছাই প্রয়োগ করা।
*পরিস্কার পানি জোরে স্প্রে করা।

*আধা ভাঙ্গা নিম বীজের (৫০ গ্রাম এক লিটার পানিতে ২৪ ঘণ্টা ভেজানোর পর মিশ্রণটি ছাঁকতে হবে) রস আক্রান্ত গাছে ১০ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
*সাবানের পানি (১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম) স্প্রে করা যেতে পারে।
>এ পোকার আক্রমণ বাহির হতে বোঝা যায় না বিধায় ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং মাঝে মাঝে ক্ষেত পরিদর্শন করে ফসলের অবস্থা দেখে আগে থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
>সাদা রংয়ের আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে।
>জৈব বালাইনাশক হিসেবে প্রতি ১ লিটার পানিতে ১ মিলি হারে “ইকোম্যাক” ও ১.৫ মিলি হারে “বায়োট্রিন” সাত দিন পর পর গাছের পাতার নিচের অংশ ভালোভাবে ভিজিয়ে পর্যায়ক্রমে স্প্রে করতে হবে।


ফল_ছিদ্রকারী_পোকা ( Fruit borer)
️ক্ষতির ধরণঃ
√ এ পোকার ফলের বোটার কাছে ছিদ্র করে ভেতরের অংশ খায়।
√ একটি পোকা একাধিক ফলে আক্রমন করতে পারে। বিকল্প পোষকের উপস্থিতিতে এ পোকা বিস্তার লাভ করে।


⏩জৈব ও যান্ত্রিক পদ্ধতিতে দমন ব্যবস্থাপনাঃ
√জমি থেকে ডিম ও কীড়া সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলতে হবে।
√জমিতে বন্ধু পোকা “ট্রাইকোগ্রামা” সংরক্ষণ করতে হবে।
√প্রতি বিঘায় ০৬ টি হারে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ “স্পোডো-লিউর” ব্যবহার করতে হবে।
√প্রতি ১ লিটার পানিতে ০.২ গ্রাম হারে “স্পোডো-এনপিভি” মিশিয়ে ১ সপ্তাহ অন্তর গাছের পাতার নিচের অংশ ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।








Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url