তরমুজ চাষ পদ্ধতিঃ
জাতঃ
জাম্বু, গ্লোরি (সুপ্রিম সীড), ফিল্ডমাষ্টার, চালর্সটন গ্রিউ, বিগ টপ, পাকিজা(এ আর মালিক), সুইট গ্রীন, সুইট ড্রাগন, গ্রীন ডায়মন্ড, সুগার কিং, কালো মানিক(ইস্পাহানি), ডক্টর সুপার, ব্ল্যাক জায়ান্ট (লাল তীর), ড্রাগন কিং(সিনজেন্টা), পাওয়ার, উইনার, বিগ ফ্যামেলি, পাগলা জাগুয়া(ইউনাইটেড সিড) ইত্যাদি৷
জমি তৈরিঃ
প্রয়োজনমতো চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে সাধারণত বড় ট্রাক্টর দিয়ে এক চাষ ও পাওয়ার টিলার দিয়ে দুই চাষ দিতে হবে৷ জমি তৈরির পর মাদা প্রস্তুত করতে হবে। মাদাতে সার প্রয়োগ করে চারা লাগানো উচিত।
বেড তৈরিঃ
জমি তৈরির পর এক একটি বেডের দৈর্ঘ্যে ৮ ফুট, প্রস্হ ৮ ফুট করে এবং উচ্চতা হবে কমপক্ষে ৬ ইঞ্চি৷ এভাবে পরপর বেড তৈরি করতে হবে৷ এরুপ পাশাপাশি দুটি বেডের মাঝখানে ১.৫ ফুট ব্যাসের সেচ ও নিকাশ নালা থাকবে৷
মাদা তৈরিঃ
মাদার আকার হবে গোলাকার, যার ব্যাস ২০ ইঞ্চি ও গভীরতা ২০ ইঞ্চি৷ নালা থেকে ১ ফুট ভিতরে মাদা তৈরি করে সেখান থেকে ৬ ফুট দুরে আরেকটি মাদা হবে৷ এভাবে একটি বেডে ৬ ফুট অন্তর ২ টি সারি হবে৷ মাদার উপরের মাটির সাথে ভালো করে সার মিশিয়ে উপরের মাটি গর্তের নিচে, নিচের মাটি গর্তের উপরে দিতে হবে৷ সার ও মাটি যেন ঠিকমতো মিশে সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে৷ তারপর গর্তের মুখ ঢেকে দিতে হবে এবং ৭ দিন পর এসে গর্ত খুঁড়ে আবার মাটির সাথে সার ঠিকমত মিশেছে কিনা তা পরীক্ষা করে আবার গর্তের মুখ বন্ধ করে দিতে হবে৷
বীজের অঙ্কুরোদগমঃ
সাধারণত কৃষকরা শীতকালে বীজের অঙ্কুরোদগম সমস্যায় পড়েন৷ এজন্য তাপমাত্রা কমপক্ষে ২৫-৩০ ডিগ্রি সেঃ প্রয়োজন৷ ১৫ ডিগ্রি সেঃ এর নিচের তাপমাত্রায় তরমুজের বীজ গজায় না৷ এজন্য বীজকে ১০-১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে উঠিয়ে প্রোভ্যাক্স ৩ গ্রাম/ ১ লি পানিতে আরো ৩০ মিঃ ভিজিয়ে শোধন করে তারপর উঠিয়ে গোবরের মাদার ভিতর কিংবা মাটির পাত্রে রক্ষিত বালির ভিতর কিংবা চুলার উষ্ণতায় বা বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বালিয়ে পলিথিন ব্যাগে বীজ ঢুকিয়ে ঝুলিয়ে রাখা এমনকি ভেজা কাপড়ের পুটলিতে বেঁধে খড়ের গাদায় কিংবা কোমরের লুঙ্গি বাঁধার স্হানে রেখে দিলেও শরীরের উত্তাপে ২/৩ দিনের মধ্যেই বীজ অঙ্কুরিত হবে৷
বীজ বপন সময়/উৎপাদন মৌসুমঃ
জানুয়ারির ৩য় সপ্তাহ থেকে শীত একটু কমলে ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত বীজ বপন করা উত্তম তবে আগাম ফলন পেতে নভেম্বর মাসেও বীজ বপন করা যেতে পারে৷
বীজ বপনঃ
সাধারণত প্রতি মাদায় ৪-৫টি বীজ বপন করা হয়। চারা গজানোর পর প্রতি মাদায় দুটি করে চারা রেখে বাকিগুলো তুলে ফেলতে হবে।
চারা রোপণঃ
বীজ বপণের চেয়ে তরমুজ চাষের জন্য চারা রোপণ করা উত্তম। এতে বীজের অপচয় কম হয়। চারা তৈরির জন্য ছোট ছোট পলিথিনের ব্যাগে বালি ও পচা গোবর সার ভর্তি করে প্রতি ব্যাগে একটি করে বীজ বপন করা হয়। বর্তমানে কোকোডাস্ট দ্বারা প্লাস্টিক ট্রে তে ও চারা তৈরি জনপ্রিয় হয়েছে৷ তবে এক্ষেত্রে চারা জমিতে রোপনের পর গোড়ায় পানি দিতে হবে যাতে কোকোডাস্ট পচে শিকড় দ্রুত মাটি ধরতে পারে৷ ২০-২৫ দিন বয়সের ৫-৬ পাতাবিশিষ্ট একটি চারা মাদায় রোপণ করতে হবে।
বীজের পরিমাণঃ
প্রতি একরে ৬০০-৮০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। চারা তৈরি করলে ৩০০-৪০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়৷
সার প্রয়োগঃ
তরমুজের জমিতে নিম্নোক্ত হারে সার প্রয়োগ করা যেতে পারে-
একর প্রতি শেষ চাষের সময় প্রয়োগঃ
গোবর/কম্পোস্ট ২০০০ কেজি, টিএসপি ৩০ কেজি, পটাশ ২৫ কেজি, জিপসাম ২০ কেজি, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ১০ কেজি ছিটিয়ে জমি ভালো করে চাষ দিতে হবে তারপর মাদা প্রতি ১ কেজি গোবর/ জৈব সার, ইউরিয়া ২০ গ্রাম, টিএসপি ৪০ গ্রাম, পটাশ ২৫ গ্রাম, চিলেটেড জিংক ৫ গ্রাম, সলুবোরন ৫ গ্রাম, কার্বোফুরান ৫ গ্রাম, কার্বেন্ডাজিম ৫ গ্রাম দিতে হবে(চা চামচের ১ চামচ=৫ গ্রাম)৷ চারা রোপনের ১০-১৫ দিন পরে ইউরিয়া ৩০ কেজি এবং পটাশ ১৫ কেজি ছোট রিং করে দিতে হবে ও আগাছা বেছে ফেলতে হবে৷ তারপর ফুল আসার পর বড় রিং করে ইউরিয়া ১৮ কেজি এবং পটাশ ১৫ কেজি প্রয়োগ করতে হবে৷
অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যাঃ
শুকনো মৌসুমে সেচ দেয়া খুব প্রয়োজন। গাছের গোড়ায় যাতে পানি জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। গাছে যখন ৮/১০ পাতা হবে তখন প্রধান শাখার মাথা কেটে দিতে হবে, তারপর যে প্রশাখা বের হবে তার ৪/৫ টি রেখে বাকীগুলো কেটে দিতে হবে, এতে মানসম্পন্ন ফল পাওয়া যাবে৷ প্রতিটি গাছে ৩-৪টির বেশি ফল রাখতে নেই। গাছের শাখার মাঝামাঝি গিটে যে ফল হয় সেটি রাখতে হয়। চারটি শাখায় চারটি ফলই যথেষ্ট। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ৩০টি পাতার জন্য মাত্র একটি ফল রাখা উচিত।
পরাগায়নঃ
সকালবেলা স্ত্রী ও পুরুষ ফুল ফোটার সাথে সাথে স্ত্রী ফুলকে পুরুষ ফুল দিয়ে পরাগায়িত করে দিলে ফলন ভালো হয়।
তরমুজের পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনঃ
পাতার বিটল পোকাঃ
প্রথম দিকে পোকাগুলোর সংখ্যা যখন কম থাকে তখন পোকা ডিম ও বাচ্চা ধরে নষ্ট করে ফেলতে হবে। পোকার সংখ্যা বেশি হলে রিপকর্ড ১০ইসি/ রিজেন্ট ৫০ এসসি ০১ মিলি/লিটার মাত্রায় অথবা মিপসিন ৭৫ ডব্লিউপি ২.৫গ্রাম/লিটার বা হেক্লেম ৫ এসজি ১০ গ্রাম/১০লিটার মাত্রায় যেকোন একটি ৫-৭ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।
পাতা সুড়ঙ্গকারী পোকাঃ
এ পোকা গাছের পাতার সবুজ অংশ খেয়ে সুড়ঙ্গ করে ফেলে। এ পোকা দমনের জন্য ইমিডান ১ গ্রাম/১ লি বা ইমিটাফ/ টিডো/এডমায়ার (ইমিডাক্লোপ্রিড) ০.৫ মিলি/১লিটার পানি আকারে পাতার উপর নিচে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে৷ হলুদ আঠালো ফাঁদ ব্যবহারে পুর্নাঙ্গ পোকা দমন হয়৷
মাছি পোকা বা ফল ছিদ্রকারী পোকাঃ
স্ত্রী পোকা ফলের খোসার নিচে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে কীড়াগুলো বের হয়ে ফল খেয়ে নষ্ট করে ফেলে এবং ফলগুলো সাধারণত পচে যায়। এ পোকা দমনের জন্য রিপকর্ড/রিজেন্ট/হেক্লেম স্প্রে করতে হবে। ফেরোমন ফাঁদ ও ব্যবহার করা যেতে পারে তবে ফুল আসার সময় ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করলে এবং ৪/৫ দিন পরপর সাবান পানি পাল্টালে সহজেই পুরুষ পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায় যা কীটনাশক ব্যবহারের চেয়েও বেশি কার্যকরী৷
লাল মাকড়/হলুদ মাকড়ঃ
চেনার উপায় : এরা দেখতে অতি ক্ষুদ্র। পাতার নীচে থাকে।
ক্ষতির ধরণ : পাতার রস চুষে খায়। পাতা কুঁচকে শুকিয়ে যায়। পরে পাতা ঝড়ে পরে। কুশির বৃদ্ধি থেমে যায়।
আক্রমণের পর্যায় : বাড়ন্ত পর্যায়
ফসলের যে অংশে আক্রমণ করে : পাতা
দমন ব্যবস্থাঃ
সালফার জাতীয় বালাইনাশক (যেমন হেসালফ ৮০% ডিএফ, কুমুলাস ৮০% ডিএফ, ম্যাক সালফার ৮০ ডব্লিউপি, থিয়োভিট ৮০ ডব্লিউজি প্রতি লিটার পানিতে ২গ্রাম হারে মিশিয়ে) ১০ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করুন অথবা ইন্ট্রাপিড ১০এসসি/ নোভাস্টার ৫৬ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০২মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। অথবা পাইমেট্রজিন/ মিথাইল আইসোপ্রোকার্ব/ এবামেকটিন জাতীয় মাকড়নাশক স্প্রে করতে হবে।
থ্রিপস
চেনার উপায় : এরা দেখতে অতি ক্ষুদ্র। পাতার উপরে থাকে।
ক্ষতির ধরণ : পাতার রস চুষে খায়। পাতা কুঁচকে শুকিয়ে যায়। পরে পাতা ঝড়ে পরে। কুশির বৃদ্ধি থেমে যায়।
আক্রমণের পর্যায় : বাড়ন্ত পর্যায়
ফসলের যে অংশে আক্রমণ করে : পাতা
দমন ব্যবস্থাঃ
ইন্ট্রাপিড ১০এসসি/ নোভাস্টার ৫৬ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০২মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। অথবা পাইমেট্রজিন/ মিথাইল আইসোপ্রোকার্ব/ এবামেকটিন জাতীয় মাকড়নাশক স্প্রে করতে হবে।
লেদা পোকাঃ
তরমুজের উপরিভাগের চামড়া খেয়ে দাগ করে ফেলে, ফল ছিদ্র করে ফেলে, শিকড়ও ছিদ্র করে ফেলে ফলে গাছ ঢলে পড়ে ও শুকিয়ে মারা যায়৷
দমন ব্যবস্হাঃ উপকারী পোকা মাকড়সা সংরক্ষন ও বংশবৃদ্ধি করা৷ ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহারে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়৷ এছাড়া কোরাজিন(পেট্রোক্যাম) জাতীয় ঔষধ ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া গিয়েছে৷
গামোসিস রোগ/ গামি স্টেম ব্লাইটঃ
এ রোগের আক্রমণে তরমুজ গাছের গোড়ার কাছের কাণ্ড পঁচে সাদা ক্ষিরের মতো বের হয়, পাতা পুড়ে যেতে থাকে ও গাছ মরে যায়। প্রতিকারের জন্য কমপ্যানিয়ন(ম্যানকোজেব+ কার্বেন্ডাজিম) বা রিডোমিল গোল্ড বা কার্জেট(ম্যানকোজেব+ সাইমোক্সানিল) ২ গ্রাম/১ লি পানি বা এক্রোবেট এমজেড ২ গ্রাম/১ লি + প্রোভ্যাক্স ২ গ্রাম/ ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫-৭ দিন পর পর গাছের গোড়া ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ফিউজেরিয়াম/ ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট রোগঃ
এ সকল রোগের আক্রমণে গাছ ঢলে পড়ে মারা যায়। ফিউজেরিয়াম উইল্ট হলে আস্তে আস্তে মারা যায় কিনৃতু ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট হলে সাথে সাথে মারা যায়৷ পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা করা হলে এ রোগের প্রকোপ কম থাকে। রোগাক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
দমন ব্যবস্হাঃ প্রোভ্যাক্স দিয়ে বীজ শোধন করতে হবে৷ এক্রোবেট এমজেড বা কমপ্যানিয়ন বা রিডোমিল গোল্ড ২ গ্রাম/১ লি এর সহিত ব্যাকটোবান বা ব্যাকট্রল ২ গ্রাম/১ লি ও প্রোভ্যাক্স ২ গ্রাম/১ লি পানি আকারে মিশিয়ে গোড়া ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে৷ যদিও এর আক্রমন হলে গাছ রক্ষা করা কঠিন হয়ে যায়৷
ফসল সংগ্রহঃ
জাত ও আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে তরমুজ পাকে। সাধারণত ফল পাকতে বীজ বোনার পর থেকে ৯০-১২০ দিন সময় লাগে। নীচের লক্ষণগুলো দেখে তরমুজ পাকা কি না তা অনেকটা অনুমান করা যায়।
ফলের বোঁটার সঙ্গে যে আকর্শি থাকে তা শুকিয়ে বাদামি রং হয়।
খোসার উপরে সূক্ষ লোমগুলো মরে পড়ে গিয়ে তরমুজের খোসা চকচকে হয়।
তরমুজের যে অংশটি মাটির ওপর লেগে থাকে তা সবুজ থেকে উজ্জল হলুদ রংঙের হয়ে ওঠে।
তরমুজের শাঁস লাল টকটকে হয়।
আঙ্গুল দিয়ে টোকা দিলে যদি ড্যাব ড্যাব শব্দ হয় তবে বুঝতে হবে যে ফল পরিপক্কতা লাভ করেছে। অপরিপক্ব ফলের বেলায় শব্দ হবে অনেকটা ধাতবীয়।
সাধারণত স্ত্রী ফুল ফোটার ৩০-৪০ দিনের মধ্যে তরমুজ পরিপক্ক হয়৷
ফলনঃ
সযত্নে চাষ করলে ভালো জাতের তরমুজ থেকে প্রতি একরে ১৫-২০ টন ফলন পাওয়া যায়।
পরামর্শের জন্যঃ
কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক
কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি ইউনিট
পিকেএসএফ এবং সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা
ইমেইলঃ siba_bau@yahoo.com