কৈ মাছ চাষ।

কৈ মাছ চাষ ব্যবস্থাপনাঃ
কৈ মাছ চাষ

কৈ মাছ  বাংলাদেশের মুক্ত জলাশয়ের সুস্বাদু একটি মাছ । ইংরেজিতে বলা হয় Climbing perch & বৈজ্ঞানিক নাম Anabas testudineus ।

চাষ পদ্ধতিঃ

বাংলাদেশে মোটামুটি ৩ ধরনের কৈ মাছ চাষ হয়।
(১)বাংলাদেশের স্থানীয় কই বা দেশী কৈ
(২) ভিয়েতনামী কৈ
(৩) থাই কই

কৈ মাছ চাষের ক্ষেত্রে খামারীরা মূলত ভিয়েতনামী কৈ বেশি পছন্দ করেন। কারণ, প্রতি ১০০ দিনে থাই/ভিয়েতনামী কৈ-এর বৃদ্ধি যেখানে ৮০ থেকে ১২৫ গ্রাম পর্যন্ত হয় সেখানে দেশী কৈ-এর বৃদ্ধি হয় মাত্র ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম হয় । ভিয়েতনামী কৈ এর কালার সুন্দর হওয়ায় বাজারে/ভোক্তাদের নিকট এ মাছের চাহিদা বেশি থাকে । আমার এলাকা ময়মনসিংহ অঞ্চলে ভিয়েতনামী কৈ সবচেয়ে বেশি চাষ হয় ।

কৈ চাষের জন্য ২০-৩০ শতাংশ আয়তন এবং ৪-৬ ফুট গভীরতা সম্পন্ন পুকুর অধিক উপযোগী । অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে, বৃত্তাকার পুকুরে কৈ এর ফলন আয়তাকৃতির পুকুরের চেয়ে প্রায় এক তৃতীয়াংশ বেশি আসে । যদিও বৃত্তাকার পুকুর তৈরি কষ্টসাধ্য তাই আয়তাকৃতির পুকুর নির্বাচন করাই শ্রেয় ।  

কৈ মাছ পাড় বেয়ে ডাঙায় উঠে আসে অনেক সময়। এ জন্য একটু খাড়া পাড়যুক্ত পুকুর হলে ভালো হয়। পুকুরে মাছ দেওয়ার পূর্বেই নাইলনের জাল দিয়ে পুকুরের চার দিকে বেড়া দিয়ে নিতে হবে ।  

 পুকুর প্রস্তুতিঃ

 কৈ মাছের পুকুর প্রস্তুতি অন্যসব ক্যাটফিশের মতই । প্রথমে পুকুর সেচ দিয়ে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে ( ৫-৭ দিন মিনিমাম )। পুকুরে কাদার পরিমান বেশি থাকলে ড্রেজার বা মানুষ দিয়ে অপসারণ করে নিতে হবে ।।  প্রতি শতকে ১-২ কেজি হারে চুন ( সম্ভব হলে গরম অবস্থায়) প্রয়োগ করা ভালো । ২৪ ঘন্টা পর গভীর নলকুপের পানি দ্বারা ৩-৪ ফুট পানি পূর্ণ করতে হবে ।। পানিতে আয়রন থাকলেও পূর্বে প্রয়োগ করা চুনের কারণে তার প্রভাব পাতিত হয়ে দূরীভূত হয়ে যায় । তারপরও আয়রনের আভাস দেখা গেলে শতকে ২৫০ গ্রাম চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে । প্রাকৃতিক খাবার তথা জুপ্লাংক্টন উৎপাদনের জন্য প্রতি শতকে ১৫০ গ্রাম রাইসব্রান/ অটোকুড়া , ১০০ গ্রাম আটা/ময়দা, ৫০ গ্রাম চিটাগুড় পানিতে মিশিয়ে ৪৮ ঘন্টা ফারমেন্টশন করে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিলে ৩-৫ দিনের মধ্যে পানিতে জুপ্লাংকটন উৎপন্ন হয়ে পানির কালার সবুজাভ দেখা যাবে ।   কৈ মাছের পুকুরে ফাইটোপ্লাংকটন উৎপাদন করার তেমন প্রয়োজনীয়তা নেই তাই সার না দিলেও চলবে ৷।  
 পোনা মজুদঃ 

পুকুরে পোনা মজুদের আগে শোধন করে নেওয়া ভালো।  এক্ষেত্রে যা করা যায়ঃ প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১-২ চামচ লবণ বা পটাশিয়াম পারম্যাঙানেট ভালোভাবে মিশিয়ে একটা নাইলনের নেটের জাল বালতিতে রেখে তাতে পোনাগুলো দিয়ে জাস্ট একটু চুবিয়ে তুলে ফেললেই হবে ।  এরপর পুকুরে ছেড়ে দিবেন ।  

নতুন চাষী ভাইয়েরা শতকে ৫০০ - ১০০০ টি পোনা মজুদ করতে পারেন । পোনা অবস্থায় ৪-৫ বেলা খাবার দিবেন, ক্রমান্বয়ে মাছ বড় হবার সাথে সাথে তা কমিয়ে ২ বেলায় নিয়ে আসতে হবে ।  

রোগবালাইঃ কৈ মাছে সাধারণত প্যারাসাইটিক সমস্যা / ক্ষত রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়ে থাকে ।  প্রতি ১৫-২০ দিন অন্তর অন্তর ভালোমানের জীবাণুনাশক এবং ১ মাস অন্তর অন্তর আইভারমেক্টিন অথবা ডেল্টামেথ্রিন প্রয়োগ করলে অনেকটাই নিশ্চিন্ত থাকা যায় ।  

কৈ মাছ চাষে কিছু কমন প্রশ্নঃ 

(১) শতকে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা কত কেজি...?

উত্তরঃ ইহা পুরোটাই আপনার এফেসিয়েন্সির উপর নির্ভর করবে ।  শতকে ৮০-১০০ কেজি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা রাখতে পারেন।  নতুন চাষী হলে আরও কম রাখাই শ্রেয় ।  

(2) অনেকেই বলে কৈ মাছ নাকি শতকে ২০০০ পিচও ছাড়া যায়,  সেক্ষেত্রে আপনার বক্তব্য কি...?

উত্তরঃ জ্বি শতকে ৫০০০ পর্যন্ত দিয়েও সফলভাবে হার্ভেস্ট করার রেকর্ড আছে আমার এলাকায় ।  মজুদ ঘনত্ব সংখ্যায় নয়,  আপনি কি পরিমাণ মাছ প্রতি শতকে উৎপাদন করবেন তার উপর নির্ভর করবে । 
(৩) কৈ মাছ কতদিন বয়সে বাজারজাত উপযোগী হয়...?

উত্তরঃ রেণু থেকে ৯০ - ১১০ দিন ।  

(৪) কৈ মাছ কত পিসে কেজি আসলে বিক্রি করা ভালো....?

উত্তরঃ আপনার এলাকার চাহিদা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে ৷  সাধারণত ৮ -১০ পিসে কেজি মাছের চাহিদা বেশি থাকে ।  

(৫) কত পিচে কেজি বিক্রি করে দেয়া অধিক লাভজনক...? 

উত্তরঃ স্বীয় অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, কৈ মাছ ১৫-২০ টায় কেজি থাকতে বিক্রি করে দেওয়া অধিক লাভজনক ।  এক্ষেত্রে সবদিক ব্যালেন্স রাখার জন্য ঘনত্ব দ্বিগুণ দেওয়া যেতে পারে ।  ধরুন, আপনি টার্গেট নিলেন ৮ -১০ পিচে কেজি করবেন এবং তার জন্য শতকে ১০০০ পিচ মাছ দিলেন । ৮৫% সার্ভাইভাল রেট ধরলে আপনার মাছের গড় ওজন দাড়াবে ৮০ - ৮৫ কেজি ।  ৮-১০ পিসে কেজি আনতে আপনার মাছের সম্ভাব্য FCR দাঁড়াবে 1.2 - 1.4 অর্থাৎ ১ কেজি মাছ উৎপাদনে ১২০০ থেকে ১৪০০ গ্রাম খাবার লাগবে ।  

আবার যদি ঘনত্ব ২০০০ করে দিয়ে ১৫-২০ পিসে  কেজি আসতেই বিক্রি করে দেন তাহলে গড় FCR থাকে 1 - 1.2  ।  প্রতি কেজি মাছ উৎপাদনে  ১০-১৫ টাকা খরচ কমানো সম্ভব এই মেথডে । এই গ্রেডের মাছ আমাদের এলাকায় প্রতি কেজিতে ৫ টাকা কম পাওয়া যায় ৮ -১০ পিসে কেজির তুলনায় । 

প্রায় সকল মাছই ছোট অবস্থায় গ্রোথ বেশি থাকে বিধায় FCR কম থাকে একটা নির্দিষ্ট সময়ে এসে গ্রোথ অনেকটাই থমকে যায় ।  যে পরিমাণ খাবার গ্রহণ করে সে অনুযায়ী গ্রোথ আসে না ।  কৈ মাছ যেহেতু  কম মূল্যের মাছ তাই এদেরকে বেশি সময় ধরে খাইয়ে তেমন কোনো ফায়দা হয় না ৷  কোনোভাবেই ৮ - ১০ পিচে কেজি অর্থাৎ প্রতিটি ১০০-১২৫ গ্রামের উপরে ওজন বানাতে যাবেন না ।  ওই বয়সে এদেরকে খাইয়ে কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া মুশকিল ।  ১২-১৪ পিচে কেজি বিক্রি করা সব এলাকায়, সবদিক থেকে পারফেক্ট ।  

আপনার এলাকায় ১৫-২০ পিচে কেজি মাছের চাহিদা / দাম কম থাকলে ৮-১০ পিচে কেজিতে এনে তারপরেই বিক্রি করতে পারেন । 

(৬) ভাসমান খাবার নাকি ডুবন্ত খাবার ইউজ করতে হবে...?

উত্তরঃ অবশ্যই ভাসমান খাবার ( আমার অভিমত )
ডুবন্ত খাবারে আমার অভিজ্ঞতা নাই বিধায় বলতে পারছি না ।  এই ঘনত্বে মাছ দিয়ে ডুবন্ত বা হাতে বানানো খাবার প্রয়োগে ভালো রেজাল্ট পাবেন না । 
(৭) সাথী ফসল হিসেবে কি মাছ দেওয়া যায়...? 
উত্তরঃ কৈ মাছের পুকুরে মাত্রাতিরিক্ত অ্যামোনিয়ার প্রকোপ থাকায় কার্পজাতীয় মাছের ভালো ফলাফল আসে না ।  কেজিতে ১০০ লাইনের শিং মাছ দিতে পারেন শতকে ৮০-১২০ পিচ বা মাগুর শতকে ৩০-৪০ পিচ ।  

(৮) কৈ মাছের পুকুরে এরেটর প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা আছে....? 

উত্তরঃ না, প্রয়োজন নেই । কই মাছের শরীরে বায়ু শোষক একটি বিশেষ অঙ্গ থাকে যাকে ল্যাবিরিন্থিন অঙ্গ (Labyrinthine organ) বলা হয় । এ কারণে এরা পানি এবং বাতাস থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করতে পারে বিধায় এরা ডাঙ্গাতেও দীর্ঘসময় জীবিত থাকতে পারে । এদের দেহ ঘন আইঁশে আবৃত থাকার কারণে ডাঙ্গাতে এদের শরীর সহজে আর্দ্রতা হারায় না ।

(৯) বাজারজাত ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা চাই.....

উত্তরঃ মাছ আড়তে না নিয়ে,  সম্ভব হলে পাইকারদের নিকট পুকুর পাড়ে বিক্রি করা দেওয়াই সবচেয়ে ভালো ।  যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকা বাঞ্ছনীয় ।  

(১০) খাবার প্রয়োগ সম্পর্কে জানতে চাই...

উত্তরঃ পোনা অবস্থায় দেহের ওজনের ২০% থেকে ক্রমান্বয়ে কমিয়ে ৩-৪ % এ নামিয়ে আনতে হবে ।  কৈ মাছ চরম খাদক প্রকৃতির।  যতই খাদক হউক না কেনো তাদের পেট ভরিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে তাহলেই নির্দিষ্ট সময়ে কাঙ্ক্ষিত গ্রোথ আসা সম্ভব ।  খাবার প্রয়োগে কিপ্টামি করলে মাছও আপনার সাথে কিপ্টামি শুরু করবে, তা বুঝতে পারবেন মাছ বিক্রির পর ।  
(১১) পানি পরিবর্তন করতে হবে কি....?

উত্তরঃ উচ্চ ঘনত্বের মজুদে অবশ্যই পানি পরিবর্তন করতে হবে,  এর কোনো বিকল্প নেই ।  সপ্তাহে ১-২ দিন কিছু পরিমাণ পানি বের করে দিয়ে নতুন পানি ঢুকাতে হবে ।  

(১২) সার প্রয়োগ করা যাবে..?

উত্তরঃ কিসের জন্য সার প্রয়োগ করবেন ভাই, ফাইটোপ্লাংকটনের জন্য তাই তো.....ফাইটোপ্লাংক্টন ক্রাশ করে এমনিতেই অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে নিয়মিত খাবার প্রয়োগ করলে ।  সার প্রয়োগ একপ্রকার নিষিদ্ধ বটে...।  প্রাকৃতিক খাবার উৎপাদনের কোনোও প্রয়োজন নেই ।  প্রাকৃতিক খাবার শুধুমাত্র পোনা অবস্থায় প্রয়োজন ।  ৫ সপ্তাহ বয়সের পর প্লাংক্টন খাওয়া অফ করেই দেয় অনেকটা ।

(১৩) পোনার দাম কেমন....? 

উত্তরঃ পোনার সাইজ এবং সিজনভেদে দামের তারতম্য হয়ে থাকে । প্রতি পিস পোনার মূল্য ৩০ - ৮০ পয়সা পর্যন্ত হয়ে থাকে  ।

(১৪) কৈ চাষের উপযুক্ত সময় কখন....?

উত্তরঃ ফাল্গুন মাসের শুরু থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত কৈ এর পোনা পাওয়া যায় ।  

(১৫) শীতকালে কৈ মাছ চাষ করা যাবে...?

উত্তরঃ করা যাবে, তবে হিউজ রিস্ক ।  আমার দৃষ্টিতে শীতকালে রোগাক্রান্ত হওয়ার দিক দিয়ে কৈ মাছ সবচেয়ে এগিয়ে ।  শরীরে ঘা হয়ে দগদগে ক্ষত হয়ে যায় । শীত শুরু হওয়ার আগেই বিক্রি করে দেওয়া উচিত ।  
(১৬) প্যারাসাইটিক/ক্ষত রোগে কি করব....?

উত্তরঃ চুন শতকে ২০০ গ্রাম,  ১ দিন পর আইভারমেক্টিন, তার ৩ দিন পর ভালো মানের কোনো জীবানুনাশক বুস্টার ডোজসহ  প্রয়োগ  করতে হবে । অবস্থা বেশি ক্রিটিক্যাল হলে এজিথ্রোমাইসিন ১০-২০ গ্রাম প্রতি কেজি খাদ্যের সাথে মিশিয়ে ৫-৭ দিন ,  ভিটামিন সি ৮ গ্রাম এবং লিভারটনিক ৫ মিলি হারে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে ।  

(১৭) কেজিতে উৎপাদন খরচ কেমন...?

উত্তরঃ সাধারণত গড়ে ৬৫ - ৭৫ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়ে থাকে প্রতি কেজি কৈ মাছ উৎপাদনে ।  

(১৮) কোন কোম্পানির খাবারে কৈ মাছের ভালো গ্রোথ আসে...?
উত্তরঃ ব্র্যান্ডেড যে কোনো কোম্পানির খাবারই ভালো ।  কোনো কোম্পানিই চায় না তাদের প্রডাক্টের মান খারাপ হোক , সবাই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চায় । তবুও যতটুকু সম্ভব স্বনামধন্য কোনো কোম্পানির খাবার ব্যবহারের চেষ্টা করবেন ।  
(১৯) কৈ মাছের খাবারে কত % প্রোটিনের প্রয়োজন হয়...?  

উত্তরঃ পোনা অবস্থায় ৩৫%,  কালচার পিরিয়ডে ৩০% + প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার দিতে হবে ।  

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ আপনি চাষে একদমই নতুন হয়ে থাকলে উচ্চ ঘনত্বের মজুদ পরিহার করুন । শতকে ৫০০-৮০০ মাছ মজুদ করতে পারেন । পানি যোজন-বিয়োজন / পরিবর্তন বাধ্যতামূলক । 
প্রিয় বন্ধুগণ, যারা কৈ মাছ নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ করেছেন, করছেন আপনারা কমেন্টে নিজ নিজ অভিজ্ঞতা, পরামর্শ এবং অভিমত সম্পর্কে  আলোচনা করতে পারেন । তাহলেই সকলের জ্ঞানের আসর হয়ে উঠবে পূর্ণ,  সময় পাবে পুর্ণতা । সাথে থাকুন , পাশে পাবেন ।  
ধন্যবাদ সকলকে ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url