কলার চাষ ও রোগ প্রতিরোধ.
কলার চাষ ও রোগ প্রতিরোধ.
কলা রুয়ে না কেটো পাত,
তাতেই কাপড়, তাতেই ভাত"
(কলাগাছ রোপন করে পাতা যেন না কাটে কৃষক, কেননা তাতেই সারা বছর ভাত-কাপড় জুটবে তাদের।)
চাষাবাদের ক্ষেত্রে কৃষকরা আবহমানকাল থেকে অর্থকরী ফসল হিসেবে শুধু ধানকেই দেখে আসছেন। ধানের বহুমুখী ব্যবহার ও চাহিদার জন্যই এর প্রভাব কৃষক মহলে বেশি। প্রাচীন ধ্যান-ধারণা ক্রমেই পাল্টাচ্ছে আর এই পরিবর্তনের ফলস্বরূপ লাভজনক ফসল হিসেবে অনেকেই কলাকে চিহ্নিত করেছেন। কারণ হিসেবে জানা গেছে, ধান, পাট ও আখসহ প্রচলিত অন্যান্য ফসলের তুলনাই কলাচাষে শ্রম ব্যয় হয় কম, বিক্রি করতেও ঝামেলা নেই (বাগান থেকেই বিক্রি হয়)। অন্যদিকে কলার বাজার দরে সহজে ধস নামে না।
পুষ্টিকর ফল হিসেবেও কলার চাহিদা বেশি। সর্বোপরি একবার কলার চারা রোপণ করলে ২/৩ মৌসুম চলে যায়। কলার গাছ বড় হওয়ার কারণে গরু-ছাগলের হাত থেকে রক্ষার জন্য বেড়া (ফেন্সিং) দিতে হয় না। এক একর জমি হতে কলা বিক্রি হবে ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত। এতে সর্বোচ্চ খরচ হবে ৫০ হাজার টাকার মতো। এছাড়া কলার মোছা একটি উৎকৃষ্টমানের তরকারি হিসেবে ব্যবহ্নত হয়।
যেভাবে চাষ শুরু করতে হবে----
জাত বাছাই : বারি কলা-১, বারি কলা-২(আনাজি কলা),অমৃত সাগর, মেহের সাগর, সবরি, অনুপম, চাম্পা, কবরী, নেপালি, মোহনভোগ, বাইশছড়ি, মানিকসহ বিভিন্ন জাতের কলাচাষ হয়ে থাকে। তবে এলাকাভেদে স্হানীয় জাতের কলা (দেশী কলা), সবরি, মানিক, মেহের সাগর ও নেপালি কলার চাহিদা অত্যন্ত বেশি, চাষও হয় ভালো এবং খেতেও অনন্য।
জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ : ২/৩ বার চাষ দিয়ে জমি ভালোভাবে তৈরি করে নিতে হয়। অতঃপর জৈবসার (যেমন গোবর, কচুরিপানা ইত্যাদি) একরপ্রতি ৫ টন হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে। অতঃপর ৭/৭ দূরত্বে গর্ত খনন করতে হবে। প্রতিটি গর্তে ৬ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম খৈল, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম এমপি, ১০০ গ্রাম জিপসাম, ১০ গ্রাম জিংক এবং ১০ গ্রাম বরিক এসিড, ৫০ গ্রাম কার্বোফুরান প্রয়োগ করে মাটি দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। ১৫ দিন পর প্রতিটি গর্তে নির্ধারিত জাতের সতেজ ও সোর্ড শাকার (তরবারি চারা) চারা রোপণ করতে হবে। এভাবে একরপ্রতি সাধারণত ৮৮০-৯০০ টি চারা রোপণ করা যায়। পরবর্তী সময়ে ২ কিস্তিতে গাছপ্রতি ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম এমপি ৩ মাস অন্তর অন্তর প্রয়োগ করতে হবে।
রোপণের সময় : কলার চারা বছরে তিন মৌসুমে রোপণ করা যায়। প্রথম মৌসুম মধ্য জানুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ। দ্বিতীয় মৌসুম মধ্য মার্চ থেকে মধ্য মে। তৃতীয় মৌসুম মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য নভেম্বর।
চারা রোপণঃ রোপণের জন্য ‘অসি তেউড়’ উত্তম। অসি তেউড়ের পাতা সরু, সূচালো এবং অনেকটা তলোয়ারের মত, গুড়ি বড় ও শক্তিশালী এবং কাণ্ড ক্রমশ গোড়া থেকে উপরের দিকে সরু হয়। তিন মাস বয়স্ক সুস্থ তেউড় রোগমুক্ত বাগান থেকে সংগ্রহ করতে হয়। সাধারণত খাটো জাতের গাছের ৩৫-৪৫ সেন্টিমিটার ও লম্বা জাতের গাছের ৫০-৬০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের তেউড় ব্যবহার করা হয়।
অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা : শুকনো মৌসুমে ১৫-২০ দিন পর পর সেচের প্রয়োজন হয়। গাছ রোপণের প্রথম অবস্থায় ৫ মাস পর্যন্ত বাগান আগাছামুক্ত রাখা জরুরি। কলাবাগানে জলাবদ্ধতা যেন না হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
সাথী ফসল : চারা রোপণের প্রথম ৪/৫ মাস বলতে গেলে জমি ফাঁকাই থাকে। যদি সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে চারা রোপণ করা হয়, তবে কলাবাগানের মধ্যে আন্তঃফসল হিসেবে মিষ্টি কুমড়া, শসা, মরিচ ও বিভিন্ন ধরনের সবজি উৎপাদন করা যায়।
কলার রোগ ও প্রতিরোধ : সাধারণত কলাতে বিটল পোকা, পানামা রোগ, বানচিটপ ভাইরাস ও সিগাটোকা রোগ আক্রমণ করে থাকে। বিটল পোকায় আক্রান্ত হলে কলা সাধারণত কালো কালো দাগযুক্ত হয়। প্রতিরোধের জন্য ডেনিম প্লাস/ম্যালথিয়ন অথবা সেভিন ৮৫ ডব্লিউপি প্রয়োগ করা যেতে পারে। পানামা রোগে সাধারণত কলাগাছের পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গাছ লম্বালম্বি ফেটে যায়। এ রোগের প্রতিরোধে গাছ উপড়ে ফেলা ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। বাঞ্চিটপ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে কলার পাতা আকারে ছোট ও অপ্রশস্ত হয়। এটি দমনের জন্য সুমিথিয়ন পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে। সিগাটোগায় আক্রান্ত হলে পাতায় ছোট ছোট হলুদ দাগ দেখা যায়। এক সময় এ দাগগুলো বড় ও বাদামি রং ধারণ করে। এ অবস্থা দেখা দিলে আক্রান্ত গাছের পাতা পুড়ে ফেলতে হবে এবং টিল্ট-২৫০ ইসি অথবা ব্যাভিস্টিন প্রয়োগ করা যেতে পারে৷
ফসল সংগ্রহঃ রোপনের ১ বছরের মধ্যেই ফলন আসে৷
রোগ নিরাময়ে কলার ব্যবহার
১. শুষ্ক কাশিতে : একটি পাকা কলা চটকে অল্প পানিতে মিশিয়ে হালকা গরম করে সেটাকে ছেঁকে নিয়ে সেই পানিটা সকাল ও বিকালে কয়েক দিন খেলে উপশম হবে। তবে প্রতিদিন নতুন করে তৈরি করতে হবে।
২. সন্ধিযুক্ত গলক্ষতে : গলায় ব্যথা, লাল দেখায়, কর্ণমূল পর্যন্ত ব্যথা, মনে হয় যেন গলায় ঘা হয়েছে, গলার স্বর ভাঙা ভাঙা; এ ক্ষেত্রে একটা পাকা কলা ১ কাপ পানি দিয়ে চটকে গরম করে ছেঁটে নিয়ে সকালে এবং নতুন করে তৈরি করে বিকালে খেতে হবে। মাসখানিক খেলেই উপশম হবে।
৩. কৃমিতে : ১ চা-চামচ কলাগাছের শিকড়ের রস সকালে খালি পেটে ১ সপ্তাহ খেতে হবে। প্রাপ্ত বয়স্ক ৩-৪ চা-চামচ, কিশোর বয়স্কদের ২ চা-চামচ আর শিশুদের ১ চা-চামচ খাওয়াতে হবে।
৪. ডায়রিয়াতে : কাঁচাকলা দুই তিনটা খোসাসহ দুই-টুকরো করে কেটে অল্প পানিকে সিদ্ধ করে কলার ভর্তা ৪-৫ বার খেলে দাস্ত বা বেশি পায়খানা বন্ধ হয়ে যাবে। পাশাপাশি খাবার স্যালাইনও চলবে।
৫. প্রসূতির কাঁচা নাড়ি শুকাতে : প্রসবের পর শরীরকে ঝরঝরে করার জন্য কাঁচা কলা পুড়ে ভর্তা করে ভাত খেতে দিতে হবে।
কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক
কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি ইউনিট
পিকেএসএফ এবং সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা
ই-মেইলঃ siba_bau@yahoo.com